চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ৪নং পালাখাল মডেল ইউনিয়নের ভূইয়ারা ও নয়াকান্দি গ্রামের মাঝখানে সুন্দরী খালের পূর্বপাশে ডিবির মতো একটি জায়গায় ১৪ টি বাঁশঝাড় নিয়ে মনসা মুড়া গড়ে উঠেছে। কিন্তু মন্দির তৈরির লক্ষে ৩০ জানুয়ারী মনসা মুড়ার বাঁশঝাড় কেটে ঐতিহ্য ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে একটি মহল। এভাবে বাঁশঝাড় কাটলে মনসা মুড়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ মনসা মুড়ার বাঁশঝাড় রক্ষার্থে উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে দাবী জানিয়েছেন সনাতন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।
কথিত আছে মনসা মুড়ার একটি বাঁশ কিংবা বাঁশের কঞ্চি যে কাটবে তার পরিবারের ধ্বংস অনিবার্য। লোকমুখে এও প্রচলিত আছে, মনসা মুড়ার শুকনো বাঁশ ও বাঁশপাতা কুড়িয়ে রান্নার জন্য নিয়ে গিয়েছিলো দহুলিয়া গ্রামের এক ব্যক্তি। রাতের বেলায় তার স্ত্রী রান্না করতে গেলে দেখে সারাঘরে সাপে কিলবিল করছে। পরদিন সে ব্যক্তি বাঁশ ও বাঁশপাতা যথাস্থানে রেখে আসে। প্রায় একই ঘটনা ঘটে ভূঁইয়ারা গ্রামের আরেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে। ঘরের খুঁটি দিয়েছিলো মনসা মুড়ার বাঁশ দিয়ে। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার।
সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে ১৯৪০ সালে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে এক বেদের দল মনসা মুড়া থেকে সাপ ধরতে গিয়ে ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়। দুদিন পর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বেদে সর্দারের। ১৯৮০ সালে ঘটে আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা। ভূঁইয়ারা গ্রামের আব্দুল মালেক ঘোষণা দেন মনসা মুড়া থেকে সাপ ধরবে। নির্ধারিত দিনে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে আব্দুল মালেক মনসা মুড়ায় গর্ত করে একটি সাপ ধরে ঝাঁপিতে রাখে। পরে ঝাঁপিতে আর সাপটিকে দেখা যায়নি। এর দু’বছর পর সাপের দংশনে মৃত্যু হয়েছে মালেকের। এমনি অনেক রোমাঞ্চকর ও ভীতিকর কাহিনী প্রচলিত আছে মনসা মুড়াকে ঘিরে। এলাকার মানুষ এই বাঁশঝাড়গুলোকে ভয় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বাঁশঝাড়গুলোর এক কোণে ছোট একটি মনসা মন্দির আছে। এলাকার মানুষ দুধ কলা মনসা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পহেলা বৈশাখে এখানে মেলা বসে।
মনসা মুড়ার এই বাঁশঝাড় গড়ে উঠার ইতিহাস পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সম্পর্কিত। রহস্যময় মনসার বাঁশঝাড়ের উৎপত্তি ও নামকরণ নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। অনেক অনেক বছর আগে সাপের দেবী মনসা ও তার সঙ্গীরা সুন্দরীখালের পাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেলে দেবীর দল বিশ্রাম নেয়ার জন্য খালের পূর্বপাড়ে নৌকা ভেড়ান। বিশ্রাম শেষে চলে যাওয়ার সময় মা মনসা সেখানে একটি বাঁশের চারা রোপণ করে যান। আর এ চারা থেকে কালক্রমে অসংখ্য বাঁশের সৃষ্টির ফলে জন্ম হয় এ বিশাল বাঁশের ঝাড়ের। স্থানীয়দের নিকট বিশ্বাস এ ঝাড়ে আছে অগণিত সাপ। দিনের বেলা মানুষের চলাচলের কারণে বাঁশের রূপ ধারণ করে থাকা এ সাপগুলো রাতের বেলা হয়ে উঠে জীবন্ত।
ভিন্নমতে প্রচলিত আছে যে, বেহুলা দেবী তার স্বামী মৃত লক্ষিন্দরকে কলার ভেলায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে মনসা দেবীর আশীর্বাদে লক্ষিন্দর প্রাণ ফিরে পান। পরিত্যক্ত কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে এসে ভিড়ে এই স্থানের উঁচু ডিবিতে। ভেলা তৈরি করতে যে বাঁশ ব্যবহৃত হয়েছে তার থেকেই ক্রমান্বয়ে পরিণত হয়েছে মনসা মুড়ার।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আলোচিত ও ঐতিহ্যবাহী মনসা মুড়াটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে জেলা ব্র্যান্ডিং-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এই জায়গাটির সংস্কার ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুর সবুর মন্ডল ২০১৮ সালে মনসামুড়া পরিদর্শন করেন।
মনসা মুড়া উন্নয়ন কমিটির সভাপতি প্রানধন দেব একক সিদ্ধান্তে ঐতিহ্যবাহী মনসা মুড়ার স্থানে মনসা মন্দির করার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে মনসা মুড়ার অনেক বাঁশ কেটে ফেলা হয়। স্থাপনা তৈরি করতে হলে আরো বাঁশ কাটা হবে বলে মনসা মুড়া উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ভূঁইয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র দাস জানিয়েছেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা বাঁশ কাটতে বাঁধা দিলে প্রাণধন দেব তা অমান্য করেন। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সংগঠন মনসা মুড়ার বাঁশ কাটার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ফনিভূষন মজুমদার তাপু এবং সাধারণ সম্পাদক বিকাশ সাহা মনসা মুড়ার বাঁশ কাটার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং অবিলম্বে স্থাপনা তৈরির কাজ বন্ধ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পাশাপাশি পাশর্^বর্তী স্থানে মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান তারা।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাবিব মজুমদার জয় বলেছেন, যেহেতু জায়গাটি মনসামুড়া নামে পরিচিত। সেহেতু মনসা মুড়ার বাঁশ কেটে জায়গাটির ঐতিহ্য নষ্ট করা ঠিক হয়নি। তাছাড়া মানুষের বিশ্বাস ছিলো এখনকার বাঁশ কাটা যায় না, মানুষের বিশ^াস নষ্ট করা ঠিক হয়নি।
মনসা মুড়ার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি প্রাণধন দেব বলেছেন, বাঁশ কাটার জন্য আমি ১ বছর আগে মন্দিরে পূজা দিয়েছি। এখন সিগনাল পেয়ে আমি বাঁশ কেটেছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইকবাল হাসান জানান, মনসা মুড়ার বাঁশ কাটা ঠিক হয় নি। তবে ওই মুড়ার বাঁশ যেনো আর না কাটা হয় সেজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্দির কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছি।
কচুয়া প্রতিনিধি, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪