Home / আন্তর্জাতিক / ‘আমার ভাগ্যে কখনই স্বামী জুটবে না’
Rohinga
ফাইল ছবি

‘আমার ভাগ্যে কখনই স্বামী জুটবে না’

মুখোশ পরা সেনার রুক্ষ ও নোংরা হাত যখন আজিদার পা সরিয়ে তার গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেললো, মেয়েটি তখন চিৎকার করে উঠলো। হাতজোড় করে তাকে থামতে বললো। লম্পট সেনা তাতে ভ্রূক্ষেপও করলো না। ধর্ষণ করলো মেয়েটিকে।

এরও কয়েক মিনিট আগে চোখের সামনে সেনাদের গুলিতে নিজের পিতা-মাতাকে নিহত হতে দেখেছে ১৩ বছর বয়সী আজিদা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা তারা। ওই মুহূর্তে লুকিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচায় সে। এক পর্যায়ে পাশের জঙ্গল দিয়ে পালানোরও চেষ্টা করে। কিন্তু দ্রুতই সে আটকা পড়ে সেনাদের হাতে।

এই রোহিঙ্গা কিশোরীর ভাষ্য, ‘(ধর্ষণের সময়) আমি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করি। কিন্তু, আমার মাথায় তখন শুধুই নিজের সতীত্ব হারানোর চিন্তা। আমি আর সতী নই। আমি এখন থেকে অচ্ছুৎ। আমার ভাগ্যে কখনই স্বামী জুটবে না।’

আজিদাদের গ্রামের নাম কাওয়ারবিল। ছয় সপ্তাহ আগেই সেনারা ওই গ্রামে আক্রমণ করে। পুড়িয়ে দেয় আজিদাদের ঘরও। পরে অন্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে সে ও তার বোন পালিয়ে আসে বাংলাদেশে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের শুরুটাই ছিল এমন নিষ্ঠুরতায় ভরা। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণের পরও আজিদার মতো শরণার্থী শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার হুমকি দূর হয়নি।

ইউনিসেফের শরণার্থী সুরক্ষা বিষয়ক প্রধান জ্যঁ লিয়েবি বলেছেন, এই যাত্রায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর পর থেকে ৮শ’রও বেশি লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার কথা উল্লেখ করেছে শরণার্থীরা। এসব ঘটনার অর্ধেকেরও বেশি হলো যৌন নিগ্রহ সংক্রান্ত।

এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তাদের আগমন যেন থামছেই না। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের একটি হামলার জবাবে রাখাইনে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তখন থেকেই শুরু শরণার্থীদের স্রোত। জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওই সামরিক আক্রমণকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের বক্তব্য, সেনাবাহিনী ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে লড়ছে, যারা কিনা বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছে।

এই পর্বে আগত রোহিঙ্গাদের ৬০ ভাগেরও বেশি শিশু। এক মাস আগে আজিদা এসেছে তার ১৫ বছর বয়সী বড় বোন মিনারার সঙ্গে। তাদের পরিবারের আর কোনো সদস্য বেঁচে নেই। কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে বাঁশ আর প্লাস্টিক নির্মিত একটি তাঁবুতে এখন তাদের বসবাস। আর এখানেও নিরাপদ বোধ করছে না তারা।

মিনারা বললো, ‘আমার মা-বাবা আর দুই বড় বোনকে সেনারা হত্যা করেছে। আমাদের দেখভালের আর কেউ নেই। শুনলাম, এই শিবিরেই গত কয়েকদিন আগে ধর্ষিত হয়েছে কিছু মেয়ে। একারণে নিজেদের তাঁবুর ভেতরেই থাকছি সারাক্ষণ।’

শিবিরের স্কুল ভবনের একটি খালি শ্রেণিকক্ষে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হয় দুই মেয়ে। সম্মত হওয়ার আগে তারা শর্ত দেয়, কক্ষে কোনো পুরুষ থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখতে বলার পাশাপাশি, পুরোটা সময় স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢাকা ছিল তাদের। মিনারা বলছিলেন, ‘যা ঘটেছে সেটা নিয়ে আমি লজ্জিত। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। কিন্তু আমার সতীত্বের সঙ্গে স্বপ্নরাও চলে গেছে।’

আজিদার পাশাপাশি মিনারাও পালানোর সময় ধর্ষিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘নিজের শরীর পুরোপুরি ঢাকার জন্য আমার যথেষ্ট কাপড় নেই। কিন্তু আপাতত যা আছে তা দিয়ে ঢাকছি শরীর।’ প্রতিবেশী একজনের কাছে ধার করা কালো বোরকা পরে এসেছে মিনারা। কথা বলতে বলতে দুশ্চিন্তায় গলা কাঁপছিল তার।

বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা কুতুপালং শিবিরে নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করেছে। ভেতরে রঙিন কক্ষ, আর বাইরে যথেষ্ট জায়গা। যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা এখানে কাউন্সেলিং আর সহায়তা গ্রহণ করছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের মুখপাত্র ভেরোনিকা পেড্রোসা বলেন, ‘তারা এখানে স্বস্তি বোধ করে। বুঝতে পারে যে, এখানের লোকজন তাদের প্রতি সহমর্মী। ফলে অনেকে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মমতা নিয়ে এখানেই প্রথম কথা বলে। মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মুখ খোলে।’

কিন্তু এত অল্প সময়ে এত বেশি শরণার্থী এসেছে যে, সবার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ইউনিসেফের লেইবি বলছিলেন, ‘নজিরবিহীন সংখ্যক শরণার্থী এসেছে মাত্র এক মাস হলো, যেমনটা বাংলাদেশ আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ এসেছে। আমরা এখন শরণার্থী শিশুদের প্রয়োজন মেটাতে পুরোদমে কাজ করছি। আমরা বিশেষভাবে যেটি পাল্টাতে চাই তা হলো ধর্ষণের সঙ্গে থাকা লোকলজ্জার ব্যাপারটি।’

শিবিরে কর্মরত ত্রাণকর্মীরা বলছেন, কাউন্সেলিং সেবা সত্ত্বেও অনেক মেয়েই বলতে চায় না যে, তারা ধর্ষিত হয়েছে। যৌন সহিংসতার শিকার মেয়েদের নিয়ে সেখানে কাজ করছেন রেবেকা ডাসকিন নামে একজন নার্স। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের পরিবেশে মেয়েরা সাধারণত ধর্ষণঘটিত লোকলজ্জা (স্টিগমা) নিয়ে ভীত থাকে। তারা নিজের পরিবারের মনোভাব নিয়েও ভয় পায়।’

মেডিকেল টিমস ইন্টারন্যাশনালের হয়ে কাজ করেন ডাসকিন। এখানে তিনি এসেছেন একটি রোগ প্রতিরোধক ক্লিনিক গড়ে তুলতে। তিনি আরো বলেন, ‘অনেক ভিকটিমের জন্য সেটাই (ধর্ষণ) ছিল প্রথম যৌন সংস্রব। তাদের এখন দরকার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তারা সহিংস ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক সংঘাত উপদ্রুত অঞ্চলে। অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ঘটেছে প্রকাশ্যে, ফলে তাদের ট্রমাও বেশি।’

কুতুপালং-এ নতুন এসব শরণার্থীরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায়, এমনকি শারীরিক ক্ষত নিয়ে এসেছেন। অনেকের শরীরেই ধারালো কিছু বা গুলির ক্ষত। কিন্তু এসবের চেয়েও মানসিক ট্রমাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

মিনারা বলছিলেন, ‘আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার বদলে বরং এখানেই মরবো। আমরা এখানে একেবারেই বাইরে বের হই না। এখানে কোনো বন্দুকও নেই। কিন্তু এখানেও কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের ধর্ষণ করতে পারে।’

মাথা নেড়ে সায় দিলো পাশে বসে থাকা আজিদা। সে বললো, ‘সেনারা যখন আমাদের জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেল, তখন আমার মনে হয়েছিল আমরা মরে যাবো। এখন আমার মনে হয়, মরে গেলেই ভালো ছিল। সতীত্ব নষ্ট হওয়ার চেয়ে সেটাই ঢের ভালো।’ সূত্র: মানবজমিন

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১১ : ৩০ এএম, ১৩ অক্টোবর, ২০১৭ শুক্রবার
এইউ

Leave a Reply