Home / বিশেষ সংবাদ / ‘ওরা পরীক্ষা দিতে দেবে না তিন বেলা খেতেও দিচ্ছে না’
fatema death

‘ওরা পরীক্ষা দিতে দেবে না তিন বেলা খেতেও দিচ্ছে না’

মা-বাবাকে বলে আমাকে নিয়ে যাও, আমি পরীক্ষা দেব, ওরা পরীক্ষা দিতে দেবে না। আমাকে তিন বেলা খেতেও দিচ্ছে না, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে—মৃত্যুর দিন শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে লুকিয়ে বড় ভাই-ভাবিকে মোবাইল ফোনে অন্তিম কথাগুলো বলেছিল ফাতেমা আক্তার।

‘সেই রাতেই ওরা নির্যাতন করে আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলে।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বললেন, মুক্তিযোদ্ধা বাবা আবদুর রশিদ। পাশেই ছিলেন ফাতেমার মা লাইলী বেগম। তিনি মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। একপর্যায়ে কান্নার দমক থামিয়ে বললেন, ‘ওর ইচ্ছে ছিল জজ-ব্যারিস্টার হয়ে মানুষের উপকার করবে। কিন্তু বখাটে মমিন আর তাঁর পরিবার ওর স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল।’

গতকাল রবিবার দুপুরে দীঘলকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল মর্মস্পর্শী দৃশ্য। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মায়াবতী কিশোরীটির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন প্রতিবেশীরাও। এলাকার আশরাফ হোসেন, নাসির মিয়া, নওসাদ আলী বললেন, খুন না আত্মহত্যা আমরা বলতে পারি না। কিন্তু সবার প্রশ্ন—হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটির এ রকম পরিণতি কেন হলো? স্থানীয় এক নারী বললেন, ‘ওর মতো একটা মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেবে এটা অসম্ভব।’

এলাকাবাসী ও নিহত ফাতেমার পরিবার সূত্র জানায়, গাইবান্ধার সাঘাটার হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর দীঘলকান্দি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদের মেয়ে কিশোরী ফাতেমা আক্তারকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন সাঘাটার দুর্গম দক্ষিণ দীঘলকান্দিচর গ্রামের সুরা হকের ছেলে বখাটে আব্দুল মমিন (২২)।

স্থানীয়রা জানান, সারা বছর নানা অপকর্মে যুক্ত মমিন নামকা ওয়াস্তে ফুলছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। চলতি বছরের ২৬ আগস্ট বখাটে মমিনের ধোঁকায় পড়ে তাঁর হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে ফাতেমা। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর কোর্টে এফিডেভিটের মাধ্যমে (বয়স বেশি দেখিয়ে) ফাতেমাকে বিয়ে করেন মমিন।

ফাতেমার বড় বোন সালমা বেগম জানান, দাম্পত্যের শুরু থেকেই ফাতেমার সংসার করার স্বপ্ন ধসে পড়তে শুরু করে। মাত্র দেড় মাসের সংসার জীবনে নানা অজুহাতে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে স্বামী মমিন ও শাশুড়িসহ পরিবারের লোকজন। ফাতেমা এসএসসি পরীক্ষা দেবে কিংবা বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে—এটা তারা মেনে নেয়নি।

আবদুর রশিদ বলেন, ‘ঘটনার দিন গত ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ফাতেমা তাঁর ভাবি ও বোনকে মোবাইল করলে ভাবি শাহিনুর বেগম, বড় বোন সালমা বেগম এবং আসমা বেগম ওই বাড়িতে যান। এ সময় তাঁদের সামনেই ফাতেমাকে বেধড়ক মারপিট করেন মমিন।

এরপর আমরা গণ্যমান্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সালিসের সময় ঠিক করি। কিন্তু ওই দিন রাতেই স্বামীর বাড়িতে শোবার ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো ফাতেমার মরদেহ পাওয়া যায়। এরপর মমিনসহ পরিবারের সবাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিনি দাবি করেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পুলিশ হত্যা মামলা না নিয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনাদানের মামলা করতে তাঁদের বাধ্য করেছে।

এলাকাবাসী আপাতত প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও অনেকেই এটি ‘সাজানো আত্মহত্যা’র ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন। ফাতেমার ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী হামিদুর রহমান বলেন, ‘ফাতেমার শরীরে ও গলায় যে ধরনের আঘাতের চিহ্ন দেখেছি তা থেকে সহজেই বোঝা যায় এটি হত্যাকাণ্ড। অথচ পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন।

অন্যদিকে, আসামি ধরার কথা বললেও আমাদেরকেই তাদের সন্ধান দিতে বলছেন।’ তবে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অনিমেশ চন্দ্র অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় সাঘাটা থানায় গত ১৩ নভেম্বর একটি আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও সহায়তাদানের অভিযোগে মমিনসহ চারজনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করা হয়।’

সাঘাটা থানার ওসি বেলাল হোসেন বলেন, ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলসীঘাটের ইম্পেরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী ফাতেমার স্বপ্ন ছিল আইন পড়া। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মাহফুজা মামুন কাফিয়া বলেন, ‘মেধাবী মেয়েটির এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল।’

বার্তা কক্ষ, ১৮ নভেম্বর ২০১৯