Saturday, 30 May, 2015 08:22:10 PM
কুড়িগ্রাম করেসপন্ডেন্ট :
কেউ ইটভাটায় কাজ করে। কেউ দিন মজুর। কেউবা আবার রিকশা চালায়। এভাবেই অভাবের সংসারে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতো ওরা। এত কিছুর মাঝে তারা এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অথচ এদের সবার পরিবারে অভাব অনটন নিত্য দিনের সঙ্গী।
ভালো ফল করে এদের অনেকেই ডাক্তার, প্রকৌশলী ও শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু, মাঝখানের দেয়াল হয়ে আছে দারিদ্রতা। এসব কারণে সন্তানদের এসব সাফল্যেও মুখে হাসি নেই অভিভাবকদের।
নাজমুন্নাহার শাকিলা
দুধকুমার নদীর ভাঙনে শূন্য হয়েছে বসতভিটা ও আবাদী জমি। সব কিছু হারিয়ে নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের নকুলার গ্রামের শাহজাহান আলী এখন দিনমজুর। সহধর্মিণী নাজমা বেগম কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। শত শূন্যতার মাঝেও তাদের মেয়ে নাজমুন্নাহার ৫ম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। তারপর বন্ধ হয়ে যায় তার পড়ালেখা। বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে আবারও পড়লেখা শুরু করে শাকিলা। আর তার এই সাহসিকতায় এগিয়ে আসে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সেই শাকিলা এবার নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। শাকিলার এই ভালো ফল জেনেও কেন যেন হাসি নেই তার বাবা-মায়ের মুখে। কারণ একটাই অভাব অনটন। সামনে আরো অনেক পথ হাটতে হবে শাকিলাকে। এই ভেবে আনন্দ যেন তাদের স্পর্শ করতে পারছে না।
মাহমুদা খাতুন
একই ইউনিয়নের মোবাল্লেগ পাড়ার ছ-মিল শ্রমিক আব্দুর রহমানের মেয়ে মাহমুদা খাতুনও একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মা রহিমা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে প্রতিনিয়ত পড়ার চাপ দিত মেয়ে মাহমুদা খাতুনকে। আর তাদের ইচ্ছাকে মূল্য দিয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি অর্জন করে মাহমুদা। তার ইচ্ছা ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সে একজন ভালো শিক্ষক হবে। মেয়ের এই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কিত তার বাবা-মা।
সহদেব কুমার
পড়ালেখায় অনেক খরচ তাই বর্গাচাষী বাবা বকুল চন্দ্র ও মা মমতা রানী চেয়েছিলেন ছেলে সহদেব কুমার তাদের সাথে মাঠে কাজ করুক। কিন্তু, ছেলের ইচ্ছা পড়ালেখা করে মানুষ হওয়ার। এ কারণে সহদেব একদিন চলে আসে নাগেশ্বরী পৌর এলাকায় সুখাতী গ্রামে তার কাকা মুকুল চন্দ্রের বাড়িতে। সেখান থেকে অদম্য ইচ্ছা শক্তি, মেধা, যোগ্যতা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা দিয়ে নাগেশ্বরী পৌর এলাকার সুখাতী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যা নিকেতনের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে চমকে দিয়েছে সবাইকে। ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও অর্থাভাবে কিভাবে সম্ভব তা সে জানেনা।
রুমানা পারভীন
নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী বাজার এলাকার গরীব শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকার ও হামিদা বেগমের ৩ মেয়ে। প্রমত্তা দুধকুমার তাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি ছাড়া করলেও সন্তানদের পড়ালেখায় অদম্য আগ্রহে কষ্ট করেও খরচ চালাতেন তারা। বাবা ও মার সে কষ্টকে শ্রদ্ধা জানাতে নিজের চেষ্টা, নিষ্ঠা, একাগ্রহতায় নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে রুমানা আক্তার পারভীন। সে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতা করতে চায়।
সহোদর শহিদুল ও এরশাদুল
রিকশাচালক বাবার সঙ্গে রিকশা চালিয়ে পড়ার খরচ মেটাতো সহোদর শহিদুল ইসলাম ও এরশাদুল হক। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে সিলেটে গেছে ইটভাটার কাজ করতে। সেখানেই কর্মরত অবস্থায় তাদের স্কুল শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকের ফোনে তারা জানতে পায় নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে তাদের জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর। বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চর বেরুবাড়ী গ্রামের রিকশাচালক গোলজার হোসেন ও অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করা মা সুফিয়া বেগম দুই সন্তানের এ সাফল্যে গর্বিত। তবে এ সাফল্যের আনন্দকে ঢেকে দিয়েছে অভাবের যন্ত্রনা। ছেলেদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে কতটুকু সহায়তা করতে পারবে তারা এনিয়ে রয়েছে শঙ্কায়।
নুর আমিন
বাবা ইমরান আলী কৃষক। মা গোলেনুর বেগম গৃহিণী। নাগেশ্বরী উপজেলার নদী ভাঙন এলাকা বেরুবাড়ীতে ১ মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে তাদের কষ্টের সংসার। সামান্য আয়ে সংসার চলে না তাই নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেও পরিবারের আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত ছেলে নুর আমিনের প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা তারা পূরণ করতে পারবে তো।
মৌসুমী খাতুন
তিন বছর বয়সেই মৌসুমী খাতুন বাবা কুদরত আলীকে হারিয়েছে। তখন থেকে বিধবা মা মমেনা বেওয়া এ বাড়ি ও বাড়ি ঝি-এর কাজ করে চালায় সংসার। গৃহস্তের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে মা-মেয়ে খেয়ে ক্ষুধা মিটাতো। এবার মৌসুমী জিপিএ-৫ পেয়ে নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ীর চিলমারী গ্রামের নাম উজ্জল করেছে। পেটের খাবার জুটতনা। সেখানে কুপির তেল কেনার টাকা পাবে কোথায়। জোৎস্নার আলোতে পড়তো সে। নাগেশ্বরীর বেরুবাড়ী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে মায়ের আশা পূরণ করলেও ভবিষ্যতের চিন্তায় তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
এসব অদ্যম মেধাবীর স্বপ্ন পূরণে দেশের হৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে এমন ভাবনা অনেক শিক্ষক আর অভিভাবকের আশার সঞ্চার ঘটতে পারে বলে তাদের আশা।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫
নিয়মিত ফেসবুকে নিউজ পেতে লাইক দিন : www.facebook.com/chandpurtimesonline/likes
চাঁদপুর টাইমস’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।