একসময় ভূমি অফিস মানেই সাধারণ গ্রাহকদের মনে দালাল ও দুর্নীতির আখড়া মনে হতো। এ ধরনের অফিসে টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। এসব পরিবেশ থেকে অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে আসছে চাঁদপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস।
সদর উপজেলা ভূমি অফিস সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) অভিষেক দাসের দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান ও বিচক্ষণতায় এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন ভূমি সংক্রান্ত সেবা নিতে আসা গ্রাহকরা।
তিনি ২০১৬ সালের নভেম্বর সদর উপজেলা এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ভূমি সংক্রান্ত অভিযোগ, নামজারি, খারিজ খতিয়ান, বিবিধ মামলাসহ যে কোনো ক্ষেত্রে সার্ভেয়ার ও কানুনঘোরসহ তার বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত কাজ করছেন। এতে করে সাধারণ মানুষ ভূমি সংক্রান্ত সেবায় হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত কম হচ্ছেন।
ব্যক্তি পর্যায়ে কিছুটা বিনয়ী স্বভাবের হওয়ায় সাধারণ গ্রাহকরা তাঁর কক্ষে ঢুকে সরাসরি সহযোগিতা নিতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার (৩ জুলাই) উপজেলার বাগাদী থেকে সেবা নিতে আসা গ্রাহক সেলিম উল্যা জানান, ‘তিনি একজন সিএনজি চালক, তাঁর খারিজ খতিয়ানের জন্যে তিনি সরাসরি এসিল্যান্ডের দ্বারস্থ হয়েছে। এসিল্যান্ড তাঁর আবেদন গ্রহণ করেছেন। এতে করে তাকে কারো সাথে মধ্যস্থতা তথা দালালের সহযোগিতা নিতে হয়নি।’
এ বিষয়ে অভিষেক দাস চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘দু’একশ’ বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি হলে এর মধ্যে দু’চারটি আপিল বিভাগে যায়, বাকিগুলোতেই বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষকেই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে আনা সম্ভব হয়। এছাড়া অনেক মামলাতেই বাদী-বিবাদীকে আপোষ মিমাংসায় যাওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়ে থাকে। এতে করে উচ্চ আদালতে ভূমি সংক্রান্ত মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমে এবং ভূমি অফিসের প্রতি মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।’
এক সূত্রে জানা যায়, ভূমি অফিসের বাইরেও জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান ও সরব উপস্থিতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রকল্প আশ্রায়ন ও গুচ্ছ গ্রাম বাস্তবায়নে সচেষ্ট অবস্থান, অধঃস্থন কর্মকর্তাদেরকে ক্ষেত্রবিশেষ প্রশিক্ষণসহ একাধিক বিষয়ে সাফল্য হিসেবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে এক প্রজ্ঞাপনে অভিষেক দাসকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
বর্তমানে তাঁর অধিনে সদর উপজেলায় টার্গেটকৃত ২৪টি আশ্রায়ন প্রকল্পের মধ্যে ১৯টি বাস্তবায়ন হয়েছে। এতে ২ হাজার ৪শ’ ৪০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
এছাড়া এ উপজেলায় টার্গেটকৃত ১৪ টি গুচ্ছগ্রামের মধ্যে ২টি গুচ্ছগ্রাম বাস্তবায়ন হয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৩০ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়েছে।
এসব প্রকল্পে প্রকৃত ভূমিহীনরা যাতে পুনর্বাসন হতে পারে সে বিষয়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ও দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
অপরদিকে বর্তমানে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রাহক বিনামূল্যে অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে নামজারী, খারিজ খতিয়ানসহ বিভিন্ন খতিয়ানের তথ্য জানতে পারছেন। দালাদের দৌরাত্ম থেকে অনেকটা মুক্ত থেকে শতভাগ অনলাইন সেবায় এগিয়ে আসছে চাঁদপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস।
উপজেলার মৈশাদী ও শাহ মাহমুদপুর এবং চান্দ্রা ও হানারচর ইউয়িনে ১ টি করে বাকি পৌরসভা ও ১০ ইউনিয়নে ১ টি করে মোট ১৩টি ভূমি অফিস (তহশিল) ডিজিটালের আওতায় এ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের অধিনে সেবা দিয়ে আসছে।
এরইমধ্যে প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ১ টি করে ল্যাপটপ, মডেমসহ যাবতীয় সরাঞ্জামাদি দেয়ার পাশাপাশি গ্রাহককে অনলাইন সেবা দেয়ার জন্যে কর্মকর্তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে চাঁদপুর টাইমসের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় সদর উপজেলা ভূমি অফিস সহকারী কমিশনার (অ্যাসিলেন্ড) অভিষেক দাস গ্রাহকসেবার নানা চিত্র তুলে ধরেছেন।
তিনি জানান, প্রতিমাসে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ টি ভূমি সংক্রান্ত বিবিধ মামলা, প্রতি মাসে অন্তত সাড় ৪ শতাধিক নামজারি ও খারিজ সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তি করে যাচ্ছে সদর উপজেলা ভূমি অফিস।
এরইমধ্যে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ভূমি সংক্রান্ত ৩৬০ টি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি ও ৫ হাজার ৫শ’ নামজারি ও জমা খারিজ সংক্রান্ত বিষয় নিষ্পত্তি হয়।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের নিজস্ব উদ্যোগে ভূমি বিভাগে সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনলাইনে সেবা দেয়ার পদ্ধতি চালু হলেও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জাতীয় পোর্টাল ষধহফ.মড়া.নফ এর মাধ্যমে গ্রাহকগণ নামজারি ও খারিজ সম্পর্কে আবেদন করতে পারছেন।
ভূমি বিভাগের এ কর্মকর্তা আরো জানান, ‘কোনো গ্রাহকের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকা কিংবা রাখার সুবাধে কোনো কর্মকর্তা আবেদনের ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি কাজের আবেদন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সকল কার্যক্রমের রেকর্ড অনলাইনে থাকে। তাই ভূমি অফিসের কোনো কর্মকর্তা চাইলেও আগের কাজ পরে, পরের কাজ আগে করার সুযোগ নেই। তাই গ্রাহকগণ সরকারি নির্ধারিত সময় কিংবা তার পূর্বে কাংখিত সেবাটি পেয়ে থাকেন।
সরকারি হিসেবে মতে নামজারি ও খারিজ আবেদন পরবর্তী ভূমি নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলে ২১-৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে গ্রাহক তার কাজ বুঝে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রবাসী গ্রাহকদের জন্যে জরুরি ভিত্তিতে ১০ দিনেরও কম সময়ে খারিজ মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।
অনলাইনে ভূমি সংক্রান্ত সেবা শতভাগ প্রদানে এগিয়ে থাকা সম্ভাবনাময় এ ভূমি অফিসে জনবলের একাধিক সমস্যা রয়েছে।
এতে ৭জন অফিস সহকারীর পদ থাকলেও কাজ করছে ২ জন। ইউনিয়ন পর্যায়েও জনবল সংকট রয়েছে।
এছাড়া ইউনিয়নগুলোতে ব্রডব্যান্ড সেবা ও কিছু ইউনিয়নে গ্রামীণের নেটওয়ার্ক পর্যাপ্ত না থাকায় অনলাইনে কাজ করতে কিছুটা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
এসব বিষয়ে সহকারী কমিশনার অভিষেক দাস চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘ভূমি অফিসের নামজারি ও খারিজ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অনলাইনে আসাতে এখন আর কাউকে হাতে খতিয়ান লিখে দিতে হয় না। সকল গ্রাহক কম্পিউটারে টাইপ খতিয়ানের প্রিন্ট কপি নিতে পারছেন। আগে সর্বনিম্ব ৪৫ কর্মদিসবসে গ্রাহক সেবা দেয়া হতো। এখন অনলাইনে কার্যক্রম হওয়াতে ২১ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে গ্রাহক সেবা দেয়া যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, ‘সাব রেজিস্ট্রি অফিসগুলো পুরোপুরি অনলাইনের আওতায় না আসায় দলিলের তথ্যাদি অনলাইনে এখনো আসেনি। গ্রাহক সাধারণত ভূমি অফিসে সেবার আবেদন করতে গিয়ে দলিলের ফটোকপি ব্যবহার করেন। তাই অনেক দলিলের ফটোকপি আমরা সত্যায়ন করতে গেলে মেইন দলিল দেখতে হয়। এতে গ্রাহক মেইন দলিল দেখাতে গিয়ে কিছুটা সময় ব্যয়ের পাশাপাশি ভোগান্তিতেও পড়েন ।
তখন আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট দলিল সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি প্রেরণ করতে হয়। তাঁরা এটি যাচাই বাছাই করে আমাদের কাছে পাঠাতে কিছুটা বিলম্ব হয়। এতে করে ভূমি সংক্রান্ত বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি করতে সময় বেশি লেগে যায়। তাই খতিয়ানের মতো দলিলগুলোরও রেকর্ড শতভাগ অনলাইনে থাকলে ভূমি সংক্রান্ত মামলা আরো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।’
প্রতিবেদক- দেলোয়ার হোসাইন