“এসএসসি পরীক্ষার আগে সেই শিক্ষক আমাকে… “

জীবন থাকলে সম্পর্ক থাকবেই। আর সম্পর্ক থাকলে থাকবে সমস্যা। প্রতিদিন ফেসবুকের ইনবক্সে ও ই-মেইলে আমরা অসংখ্য সম্পর্ক ভিত্তিক প্রশ্ন পাই, যেগুলোর কথা হয়তো কাউকেই বলা যায় না। পাঠকদের করা সেইসব গোপন প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের নিয়মিত আয়োজন “প্রিয় সম্পর্ক”। আর সম্পর্ক ভিত্তিক সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরে পরামর্শ দিচ্ছেন গল্পকার রুমানা বৈশাখী, এডিটর ইন চার্জ

আপনি চাইলে নিজের এমনই কোন একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যার কথা লিখে জানাতে পারেন আমাদের। আমরা প্রতিদিন চেষ্টা করবো বাছাইকৃত কিছু সমস্যার সমাধানে কাঙ্ক্ষিত পরামর্শটি দেবার। সমস্যার কথা লিখে জানান আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। নাম গোপন রাখতে চাইলে লিখে দেবেন “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক”। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন নিজের সমস্যার কথা।
“আমি বিবাহিতা। বিয়ে হয়েছে এক বছর হয়েছে। আমাদের পারিবারিক বিয়ে। এখন মূল কথায় আসি। আমার অতীতে আমার সাথে এমন কিছু হয়েছে যা থেকে আমি এখনো বের হয়ে আসতে পারছিনা। আমার স্বামী খুব সাপোর্টিভ এবং খুব ভালো একজন মানুষ। সে আমার থেকে প্রায়ই জানতে চায় আমার সাথে কি কিছু হয়েছে কিনা যার কারণে আমি এতটা চুপচাপ থাকি। কিন্তু আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনা। ভয় পাই যদি ও আমাকে ছেড়ে দেয় অথবা যদি আমার পরিবারকে ভুল বুঝে খারাপ জানে।

যাইহোক, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন আমার মা বাবা আমার জন্য বাসায় একজন স্যার রাখেন। তিনি আমার মামার বন্ধু এবং আমার বাবার বয়সী। আমি তখন ছোট ছিলাম তাই কোনটা আদর আর কোনটা সেক্সুয়াল এটা বুঝতাম না। তখন থেকেই আমি তিনি আমার স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে হাত দিতেন এবং বলতেন এটা নাকি আদর। আমার এসএসসি পর্যন্ত আমি উনার কাছে পড়তাম। যেহেতু উনি আমার মামার বন্ধু আর বাবার বয়সী তাই আমার মা-বাবা উনাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাই আমার পড়ার ডিস্টার্ব হবে বলে উনি আমার বাবা মাকে বলতেন রুমের দরজা বন্ধ করে পড়ালে ভালো হবে। আমি নাকি খুব অমনোযোগী তাই রুমের দরজা খোলা রাখলে আমি নাকি ঠিকমত পড়িনা। উনার আমার সমবয়সী একটা মেয়েও আছে। দিন যতই যেত, উনার সাহস ততই বাড়তে শুরু করে।

আমি যখন ক্লাস এইটে তখন উনি একদিন আমার সাথে শারিরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা করে কিন্তু আমি কান্না করে দেই আর আমি চিৎকার দিবো বলাতে কিছু করে উঠতে পারেনা। আমি আমার মা কে পরোক্ষভাবে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার মা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। উলটা আমাকে বকা দিতো। বলতো আমি নাকি স্যারের কাছে না পড়ার জন্য বাহানা করছি। উনি আমাকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলতো। যেমন উনার নাকি আমার সাথে প্রোটেকশন ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করতে ইচ্ছে করে। এটা তো একটা উদাহরন, বাকিটা আর না বলি।

একদিন আমার মা বাবা বাসায় ছিলেন না। ঐ সময় উনার আসার সময় হয়েছিলো। সেই দিন সুযোগ পেয়ে আমাকে ধর্ষণ করেন। আমি ব্যথায় খুব কান্না করি। চুপ থাকি। কারণ তখন আমি এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলাম। কোন রকমে আমি সব সহ্য করে পার হয়ে আসি ঐ জল্লাদের হাত থেকে। শিক্ষক নাকি মানুষ গড়ার কারিগর। আর ঐ জল্লাদটা আমাকে খারাপ করেছে।

আমার নিজেকে খুব খারাপ মনে হয়। এটা মনে পড়লে আমি আমার স্বামীর সাথে ক্লোজ হতে পারিনা। আমি ওকে ভয়ে কিছু বলিনি যদি ও আমাকে খারাপ ভাবে। আমার কি ওকে বলা উচিত? আমি কীভাবে এই আতঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারবো? আপু, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। আমি চাই সবার মত আমার বিবাহিত জীবনটা সুখের হোক। আমাকে আপনার মুল্যবান মতামত দিন দয়া করে”

পরামর্শ:
আপনার চিঠিটা পড়ে বারবার শিউরে উঠছিলাম আপু। ক্লাস ফোর থেকে আপনার সাথে একটা জানোয়ার এই বীভৎস যৌন নির্যাতন করেছে, টানা ৬/৭ বছর কীভাবে সহ্য করেছে আপনি! সবচাইতে অবাক লাগছে আপনার মা বাবার বিষয়টা। যতই বিশ্বস্ত মানুষ হোক, নিজেদের মেয়েকে একজন পর পুরুষের সাথে কীভাবে দরজা বন্ধ করতে অনুমতি দিলেন তাঁরা? বিশ্বাস ভালো, তাই বলে এত অন্ধ বিশ্বাস? আপনার মা-ও ব্যাপারটা বুঝতে চান নি, মেয়ের মনের অবস্থা লক্ষ্য করেন নি। এটা রীতিমত ভয়াবহ একটা ব্যাপার। আমি নিশ্চিত যে এই ভয়াবহ অবস্থার প্রভাব আপনার লেখাপড়া ও রেজাল্টেও নিশ্চিত পড়েছে। পড়তে বাধ্য। কি ভয়াবহ একটা অবস্থা!

আপু, আপনি যদি ভবিষ্যৎ জীবনটা সুখের চান, আমি মনে করি না যে এই কথাগুলো আপনার স্বামীকে বলা উচিত হবে। কারণ এখন এই ব্যাপারটা আপনার জীবনে অতীত, কিন্তু স্বামীকে যখন বলে ফেলবেন এটা বর্তমান হয়ে দাঁড়াবে। আর ক্রমশ আপনাদের দুজনের মাঝে একটা দেয়াল তুলে ফেলবে। যা করতে হবে, সেটা নিজেই নিজের জন্য করতে হবে। কী করতে হবে আমি একটু বলি।

প্রথমত আপু, আপনি ভয়াবহ কষ্টের দিন পার করে একজন চমৎকার মানুষকে স্বামী হিসাবে পেয়েছেন। এই প্রাপ্তিটুকুন ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। স্বামী হয়তো ভাবছেন যে আপনার কারো সাথে প্রেম ছিল, তাঁকে না পেয়ে মন খারাপ করছেন। তাই মন খারাপ করা চলবে না কিছুতেই। আর হ্যাঁ, স্বামী এটা বিশ্বাস নাও করতে পারেন যে লোকটি আপনাকে দরজা বন্ধ করে পড়ানোর অনুমতি পেত বা বাবা মা বাসায় না আসলেও আসতে পারতো। ফলে কী হবে, স্বামী ধরে নেবে আপনি স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক করেছিলেন, যা মোটেও সত্য নয়। এটা ধরে নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি আপনার ক্ষেত্রে। ফলে একটা মিথ্যা আন্দাজের কারণে দুজনেই কষ্ট পাবেন। তাই স্বামীকে এই কথাটা বলবেন না, বলবেন মাকে। একদম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটা কথা বলবেন। সাথেও যে আপনি কতভাবে তাঁকে বলতে চেয়েছেন আর তাঁরা কিছুই শোনেন নি, ফলাফল আপনার জীবনে এত বড় একটা দুর্ঘটনা। যত কষ্টই হোক, কথাটা আপনাকে বলতে হবে আপু। একবার বলে ফেলার পর দেখবেন যেন আপনার মনের ওপর থেকে বিশাল একটা ভার হালকা হয়ে গিয়েছে। এই কাজটি আপনি অতি অবশ্যই করবেন।

এত বছর পর ওই লোকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোন পথ হয়তো নেই। তবে হ্যাঁ, প্রতিশোধ নেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি ওই লোকের সাথে আপনার যোগাযোগ নেই, কিন্তু পরিবার যেহেতু পরিচিত, আপনি চাইলেই লোকটার ঠিকানা-ছবি ইত্যাদি বের করতে পারবেন। আপনি বেনামে ওই লোকের পরিবারে বা স্ত্রীর ঠিকানায় একটি চিঠি লিখবেন। নিজের নাম পরিচয় কিছুই দেবেন না, এমন কিছুই লিখবেন না যাতে আপনার পরিচয় প্রকাশ পায়। কিন্তু সেই জানোয়ার যে বাচ্চাদের পড়ানোর নাম করে তাঁদেরকে নিজের লালসার শিকার বানায়, ধর্ষণ করে সেটা অবশ্যই লিখবেন। তার স্ত্রী হয়তো স্বামীকে কত ভালো মানুষ মনে করে, সন্তানেরা শ্রদ্ধা করে। আপনার চিঠি কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক , তাঁদের বিশ্বাসে ফাটল ধরবেই ধরবে। তাছাড়া অনেক বছর সংসার করতে গিয়ে স্ত্রীরও চোখে কখনো না কখনো কিছু না কিছু অবশ্যই পড়েছে। সেই মহিলার জানার অধিকার আছে যে স্বামী বাইরে কী করে। আনি চাইলে চিঠি নাও পাঠাতে পারেন। তবে আমি হলে পাঠাতাম।

তৃতীয় যে কাজটি করবেন, স্বামীকে যদি একান্তই সব বলতে চান তাহলে সবটা না বলে কিছুটা বলবেন। এটুকু বলতে পারেন যে পারিবারিকভাবে পরিচিত একজন আপনাকে পড়াত। সেই লোক আপনাকে নানান ভাবে উত্যক্ত করেছে, হুমকি ধামকি দিয়েছে, প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। আপনি সেই ভয় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আপনার স্বামীকে আপনি হারাতে চান না। তাই ভয় লাগে যে শয়তান লোকটা এসে আপনাদের জীবন এলোমেলো করে দিবে। এটুকু যদি গুছিয়ে বলতে পারেন, দেখবেন স্বামী আপনাকে ফুল সাপোর্ট দিচ্ছে। ওই জানোয়ার ভবিষ্যতে কিছু করতে চাইলেও স্বামীর কারণে পারবে না।

এই কাজগুলো করে ফেলা পর, দেখবেন আপনার মনে বেশ খানিকটা শান্তি লাগছে। কাউকে বলতে না পারার কষ্টটা চলে যাবে, স্বামীকে হারানোর ভয়ও কমবে। এরপর আপনি যা করবেন, অতীত নিয়ে চিন্তা করা একেবারেই বন্ধ করে দেবেন। এমন কিছু করবেন যেটা নিয়ে খুব ব্যস্ত কাটবে সময়। চাইলে চাকরি বাকরি করতে পারেন, আপনার ও স্বামীর ইচ্ছা থাকলে সন্তানও নিতে পারেন। চাকরি বা সন্তান জীবনের একটা নতুন দিক খুলে দেবে। বিশেষ করে মা হবার পর দেখবেন যে মন মানসিকতা একেবারে বদলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন আর আপনাদের সংসারটাও মজবুত হবে। আপনি চাইলে এমন কিছু করতে পারেন, যা আপনার মত ছোটবেলায় নির্যাতিত মেয়েদের হেল্প করবে। আর কিছু না হোক, অনলাইনে মা-বাবাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন করতে পারেন। এটাও মানসিক শান্তি মিলবে। আপনার কষ্ট আর আতঙ্ক অনেক বেশি, কারণ ওই সময়ে আপনি কিছু করতে পারেন নি। এখন সেই খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসুন, দেখবেন আতঙ্ক কেটে যাচ্ছে। আরেকটি কথা আপু, স্বামীকে শারীরিকভাবে দূরে ঠেলে দেবেন না। বরং স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক উপভোগ করতে চেষ্টা করুন, স্বামীর ভালোবাসা উপভোগ করুন। শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন স্মৃতি তৈরি হতে দিন মনে। দেখবেন আস্তে আস্তে আতঙ্ক কমে ভালো লাগা চলে আসবে।

আর আপু, মনে কথা বলার জন্য আমি সবসময় আছি। যখনই কিছু বলতে মন চাইবে, লিখবেন। আমি সবসময় আছি আপনার কথা শোনার জন্য।

একটা কথা জেনে রাখবেন, আপনি খারাপ নন। আপনাকে কেউ নির্যাতন করেছে বলে আপনি খারাপ হয়ে যান না। আপনার ভালো খারাপের নির্ণায়ক আপনার শরীর নয়, আপনার কর্ম। একটা জানোয়ার সুযোগ পেয়ে আপনার শরীরে নিজের লালসা মিটিয়েছে বলে নিজেকে দোষ দেবেন না আপু। (প্রিয়.কম)

নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট : ০৪:৩০ এএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫, শুক্রবার

ডিএই

Share