সামনে এমন নির্বাচনই দেখতে চায় জনগণ ।
কেমন হলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন? এ রকম প্রশ্নের উত্তর আমাকে বহুবার বহুভাবে দেশি-বিদেশি এবং টেলিভিশন টক শোতে দিতে হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন ছিল নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেমন ছিল? অবশেষে ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন (দু-এক জায়গায় গোলযোগ এবং বেশ কয়েক জায়গায় ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছিল বলে একাধিক তথ্য রয়েছে) তবু বলা যায় মোটামুটি ভালোই হয়েছে। কারণ, নির্বাচনপূর্ব সময়ে আমার পূর্বতন অভিজ্ঞতা এবং বিজয়ী প্রার্থীর কৌশল ও আত্মবিশ্বাস, যা আগের নির্বাচনে দেখেছি, তাতে ফলাফল যেমন আশা করা হয়েছিল, তেমনই হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিকতার কিছুটা জ্ঞানের আলোকে আমার ধারণা ছিল যে নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হলে মনিরুল হক সাক্কু পুনর্নির্বাচিত হবেন।
কুমিল্লায় সিটি করপোরেশন হিসেবে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচন ছিল এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের, যার একজন কমিশনার ছিলাম আমি। কুমিল্লার প্রথম নির্বাচন বেশ ব্যতিক্রমধর্মী এবং গুরুত্বপূর্ণও ছিল। কারণ, ওই নির্বাচনই ছিল বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটি সম্পূর্ণ নির্বাচন, যা বহুল আলোচিত-সমালোচিত ইভিএমের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছিল। ইভিএমের সঙ্গে সব কটি কেন্দ্রে ওয়েব ক্যামেরা আর ল্যাপটপের ব্যবহারে ওই সময়ের মোট ৬৫টি কেন্দ্রের নির্বাচিত কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষামূলক ভোট গ্রহণকালে পূর্ণ সময় সিডিতে ধারণ করা হয়েছিল, যাতে কোনো অভিযোগ খতিয়ে দেখা যায়।
যদিও ওই সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় ছিল, তবু বিএনপি ইভিএমের বিরোধিতা করে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে ওই দলের সদস্য ও অন্যতম প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু দল থেকে পদত্যাগ করে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সমর্থিত আফজল খানকে প্রায় ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন। ওই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। এসব নতুনত্ব এবং ধারাবাহিকভাবে তুলনামূলক সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে মানুষের মনে ভোট প্রদানের বিষয় নিয়ে সংশয় ছিল না। কোনো একটি কেন্দ্রও বন্ধ করতে হয়নি। জাল ভোটের কোনো অভিযোগ করার কোনো সুযোগই ছিল না। সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ। কোনো এক চ্যানেলের উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রে উন্মুক্ত স্থানে মেয়র পদপ্রার্থীদের জনসমক্ষে বিতর্কের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
এবারের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায়, পেপার ব্যালটের মাধ্যমে। তবে এবার সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু আর নৌকা মার্কা নিয়ে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমার মধ্যে। সীমা একজন উচ্চশিক্ষিত এবং কুমিল্লা পৌরসভা, পরে সিটি করপোরেশনের রাজনীতির সঙ্গে ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। প্রার্থী হিসেবে তিনি যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিলেন। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তিনি এবার সাক্কুর অবস্থানকে টলাতে পারবেন। হয়তো কুমিল্লায় হতে পারত দেশের দ্বিতীয় নারী মেয়র। কিন্তু এমনটি হয়নি। কেন হয়নি তার দলীয় ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, ভোটের সমীকরণ সহজে ধারণা করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। যেমন হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে, যে বিশ্লেষণ হয়তো চলবে। তবে কয়েকটি মূল কারণ অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
কুমিল্লা নির্বাচনটি ছিল সদ্য নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের প্রথম বড় নির্বাচন। এই কমিশনের, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিরোধী দল বলে পরিচিত বিএনপির জোর আপত্তি ছিল। নতুন করে কারণ উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি না। তিনি শপথ গ্রহণের পর নিরপেক্ষভাবে কাজ করবার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে এবারের এই নির্বাচনে। ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে এনেছিলেন কুমিল্লার প্রথম নির্বাচনের বহু বিষয়। সর্বোপরি ব্যবস্থাপনায় নিরপেক্ষতার ছাপ রেখেছেন। একাধিকবার প্রায় সব কমিশনার, সিটি করপোরেশনের জনগণ এবং প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচনপূর্ব সময়ে ব্যবস্থাপনার ত্রুটি যেমন লক্ষ করা যায়নি, তেমনি আচরণবিধি ভঙ্গের তেমন হিড়িক দেখা যায়নি। ভোট গ্রহণের সময়ে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বেশ তৎপর ছিলেন, যেমন ছিল নিরাপত্তা বাহিনী। তারপরও কিছু কিছু অভিযোগ উঠেছে, ত্রুটি চোখে পড়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত।
বিশ্বের যেসব দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়, তার বেশির ভাগ দেশেই শতভাগ নির্ভেজাল নির্বাচন হয় না, বিশেষ করে আমাদের মতো নতুন এবং রাজনৈতিক সমস্যাসংকুল গণতান্ত্রিক দেশে। উন্নত বিশ্বে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনে বিচ্যুতি ঘটে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে; বিচ্যুতি ঘটে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনকে কলুষিত করার মতো কর্মকাণ্ডে—যেমন ভয়ভীতি দেখানো, ব্যালট পেপার ছিনতাই, বলপূর্বক কোনো এক প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা, ব্যালট স্টাফিং এবং কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে। বিগত কমিশনের সময়ে, বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যেভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জানমালের ক্ষতি এবং নির্বাচন-ব্যবস্থাপনা তছনছ হয়েছে, তাতে জনগণের মনে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। যে ধারার পরিবর্তন দেখা যায় নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনেও গত নির্বাচনের তুলনায় ভোটের গড়পড়তা হার কম ছিল। কুমিল্লা নির্বাচনেও কিছুটা শঙ্কা রয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। এবারের ভোটের হার ছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ (৬৩.৯২%)। বিগত ভোটের হার থেকে প্রায় ১১ শতাংশ কম। যদিও সিটি করপোরেশনের পরিধি বাড়ায় ভোটারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। এবার মোট ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬০ জন, কেন্দ্র ছিল ১০৩টি, ভোট পড়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৯০টি এবং দুটি কেন্দ্র স্থগিত হওয়ায় ৫ হাজার ২৫৫টি ভোট এই হার থেকে বাদ পড়েছিল।
অতীতের তুলনায় ১১ শতাংশ কম ভোট হওয়ার কারণগুলো খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব, কারণ এ ধরনের স্থানীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গড়ের চেয়ে বেশি হয়। আমাদের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন কমিশনের নজরে আনার অনুরোধ করব, তা হলো প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল দিয়ে মিডিয়াকে দেখানোর প্রবণতা। এ রকম প্রথম নজরে এসেছিল, যা পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল, নারায়ণগঞ্জে সাংসদ শামীম ওসমানের ভোট প্রদানের সময়। এবার একই কায়দায় মনিরুল হক সাক্কু গণমাধ্যমকে দেখালেন, যা সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের পরিপন্থী। কারণ, আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গোপন ভোটের মাধ্যমে। নিকট অতীতে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অথবা অনেক এজেন্ট ভোটারদের প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট মার্কায় সিল দিতে বাধ্য করেছিলেন বলে একাধিক তথ্য এবং খবরাখবর থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কুমিল্লা নির্বাচনের সময় কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে বিভিন্ন দলের ব্যাজ পরিহিত সমর্থকদের ঘোরাফেরা করতে এবং ভোটারদের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থায় বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে দেখা গিয়েছে, যা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ এবং সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনী আইন আরপিও-১৯৭২ ধারার ৭৯-এর পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এখন অনেক স্বচ্ছ করার উপাদান রয়েছে, এমনকি রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতার মধ্যে থেকে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগও পুনর্গণনার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। এখানে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার কিছু ঘাটতি রয়েছে। এ কাজটি বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার আগে রিটার্নিং অফিসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বউদ্যোগে অথবা কমিশনের অনুমতিক্রমে পুনর্গণনা করে খতিয়ে দেখতে পারেন।
কুমিল্লায় বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর বিজয়ী হওয়ার বহুবিধ কারণ অনেকেই বিশ্লেষণ করেছেন, তবে আমার মনে হয়েছে, অন্য কারণগুলোর সঙ্গে দেশের ক্ষমতাসীন সরকারবিরোধী (অ্যান্টি ইনকামবেন্সি) বিষয় যুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে কুমিল্লা শহর এবং মধ্যবিত্ত ভোটার ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে। এর একটি বড় কারণ তনু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে নানা ধরনের সমস্যা, যা এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক মাস কুমিল্লাসহ সারা দেশে বেশ তোলপাড় হয়েছে। তোলপাড় হয়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। তনু এ প্রজন্মের ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করতেন, হয়তো এখনো করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিতভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব রেখেছে বলে মনে হয়। কুমিল্লা ঐতিহ্যগতভাবে একটি সংস্কৃতিমনা শহর। কাজেই বিষয়টি যে এই নির্বাচনে নীরবে প্রভাব ফেলেছে, তা নাকচ করা যায় না। তার ওপর মনিরুল হক সাক্কুর ব্যক্তিগত ইমেজ। ভোটারদের সঙ্গে নৈকট্য এবং তরুণ ভোটারদের সমর্থন সবই তাঁর পক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। হয়তো সরকারি দল এসব বিশ্লেষণ করবে, তেমনি বিএনপিরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন তাদের এই কৌশলী মেয়রের সফলতা, যার আলোকে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ।
যা-ই হোক, কুমিল্লার নির্বাচন কতখানি সুষ্ঠু এবং কতখানি অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তা বলতে পারবেন ভোটাররা। ভোটাররা যদি বিনা দ্বিধায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে থাকতে পারেন, তাঁদের ভোট যদি সঠিকভাবে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে গণনা করা হয় এবং তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত প্রার্থী সে ভোট পেয়ে থাকেন, তবেই বলা যায় ভোট অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অনুরূপভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যদি মেনে নেন, তাহলেই বলা যায়, ভোট গ্রহণযোগ্য হয়েছে, যদিও আমাদের দেশে পরাজিত প্রার্থী সহজে হার মানতে চান না, তা ভোট যতই সুষ্ঠু হোক না কেন? এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লার নির্বাচনকে নিরূপণ করলে বলতে হয়, নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা দুরূহ, যদি না সরকারের শুধু সহযোগিতাই নয়, সদিচ্ছা থাকে। সরকারের একান্ত সদিচ্ছার কারণেই নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ভবিষ্যতেও এমন নির্বাচনই বাংলাদেশের মানুষ কামনা করে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়১২:০১ পি.এম, ০৯ এপ্রিল ২০১৭,রবিবার
ইব্রাহীম জুয়েল