অর্থনীতি

এবারও রমজান ঘিরে একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয়

প্রতিবছরের মতো এবারও রমজান ঘিরে একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে।কারসাজি করে তারা রোজা শুরুর দুই মাস আগেই পরিকল্পিতভাবে অতিব্যবহৃত নয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছে, যাতে রমজান ঘিরে দাম বাড়াতে না হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অসাধুরা এই পদ্ধতিতে কারসাজি করলেও সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবি বলছে, দুই মাসের ব্যবধানে ছোলা, মশুর ডাল, ভোজ্যতেল, আদা, রসুন, চিনি, গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগি ও খেজুর-এই নয় পণ্যের মধ্যে সর্বনিু ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

অন্যদিকে রমজান ঘিরে ভোজ্যতেলের দামে লাগাম টানতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হলেও বাজারে তা কার্যকর হয়নি। সব মিলে রোজা শুরুর আগেই বাড়তি দরে একাধিক পণ্য কিনতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে রোজা শুরুর দুই মাস আগেই অসাধুরা ভোক্তার পকেট কাটা শুরু করে। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে তদারকি কার্যক্রম জোরদার করলে অসাধুরা পণ্যের দাম কমায়।

তবে কারসাজি করে যে টাকা বাড়ানো হয়, এর চার ভাগের এক ভাগ কমানো হয়। এতে সরকার ক্রেডিট নিলেও এই বাড়ানো-কমানো খেলায় অসাধুরা প্রতিবছর রমজানকে কেন্দ্র করে ভোক্তার পকেট থেকে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা বের করে নিচ্ছে।

এবারও অভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। তাই এখন থেকেই বাজার তদারকি করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যতবার পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়, ততবারই কার্যকর হওয়ার চিত্র তেমন একটা দেখা যায় না।

এর আগে আলুর দাম নির্ধারণ করা হলেও বাজারে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরে আলুর সরবরাহ বাড়ায় এখন এমনিতেই দাম কমে গেছে। এছাড়া কয়েক মাস ধরে ভোজ্যতেলের দামে লাগাম টানতে সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হলেও তা বাজার পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

ভোক্তাকে বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে একাধিক পণ্যের দাম বাড়তি দরে বিক্রির চিত্র দেখা গেছে।

টিসিবি বলছে, এদিন রাজধানীর খুচরা বাজারে রমজানে অতিব্যবহৃত পণ্যের মধ্যে ছোলা দুই মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১০-১৫ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি মশুরের ডাল (ছোট দানা) বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা বেশি দরে। দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৬ ও বোতলজাত সয়াবিন লিটারে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রতিকেজি চিনি দুই মাসের ব্যবধানে ৫ টাকা, প্রতিকেজি আদা ১০ টাকা, রসুন কেজিতে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিকেজি গরুর মাংস ২০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

সঙ্গে দুই মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি সাধারণ মানের খেজুর বিক্রেতারা ১৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছে।

রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা, যা দুই মাস আগে বিক্রি হয় ৭০ টাকা। প্রতিকেজি ছোট দানা মশুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা, যা দুই মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা।

প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, যা ওই সময় বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি আদা ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা।

২০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি খেজুর (সাধারণ মানের) বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা, যা দুই মাসের ব্যবধানে ১৫০ টাকা বেড়েছে।

পাশাপাশি প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, যা দুই মাস আগে ৫৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৫৫ টাকা, যা দুই মাস আগে ১২৫ টাকা ছিল।

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রমজান সামনে রেখে সব পণ্য নিয়ে আমরা চিন্তা করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, রমজানে যাতে মানুষের কষ্ট না হয়। রমজানে যাতে মানুষ সাশ্রয়ী দামে পণ্য পায়-এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আর এসব বিষয়ে নজর রাখার জন্য আমাদের কমিটি ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এছাড়া রমজানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যেন সংকট না হয়, সেজন্য সরকারের একাধিক সংস্থা কঠোর মনিটরিং করছে।

এদিকে বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১১৫ ও বোতলজাত সয়াবিন ১৩৫ টাকা রির্ধারণ করা হয়েছে, যা ওইদিন থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও বাজারের চিত্র ভিন্ন।

রাজধানীর খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবার সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অমান্য করে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২৭-১২৮ টাকা। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৩৬-১৩৮ টাকা।

কারওয়ান বাজারের মুদি বেক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, এখন যে তেল আছে তা বেশি দরে কেনা। এই মজুত শেষ হলে নতুন করে কেনার সময় কম দামে পেলে অবশ্যই সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে বিক্রি করব।

তিনি বলেন, দাম নির্ধারণ করে দিলেই আমরা বিক্রি করতে পারি না। কারণ ওই দরে বিক্রি করলে আমাদের অনেক টাকা লস (লোকসান) হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দিকনির্দেশনায় রমজান উপলক্ষ্যে বাজার তদারকি শুরু হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে কোন পণ্য কী দামে কেনা ও বিক্রি কত, তা ইতোমধ্যে ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া অধিদপ্তরের টিমের সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের তদারকি সদস্যরা কাজ করছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

তিনি বলেন, এবার রমজান ঘিরে কারসাজি করলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। দরকার হলে প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হবে। এছাড়া জরিমানাসহ জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

Share