এপ্রিল ফুল মুসলিমদেরকে ধোঁকা ও হত্যার উৎসব

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
বাংলাদেশ ৯০% মুসলিমের দেশ হলেও আমরা মুসলিমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চরিত্র, ধর্ম ও সংস্কৃতি সবকিছুই যেন ভূলে গেছি ! মুসলিম হিসেবে কি করণীয় তা খুঁজে দেখিনা। এক কথায় বিবেকের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। জ্ঞান চর্চা না করে চরিত্রহীনদের অনুকরণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। তার একটি দৃষ্টান্ত হলো- এপ্রিল ফুল দিবস উদযাপন করা। এপ্রিল ফুল শব্দের অর্থ, দিবসের সূচনাকাল, প্রেক্ষাপট, মুসলিমদের সাথে এ দিবসের সম্পর্ক ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, দিবসে কী কী করা হয়, করণীয়-বর্জনীয় ও তথ্যের ভিত্তিসহ নানা দিক আমাদের জানা দরকার। এসব কিছু জানার পরে তা মেনে চলাই জ্ঞানীর কাজ। এ দিবসের প্রেক্ষাপট না জেনেই এর চর্চা করা হচ্ছে। নিজেরা যেমন এ অপসংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে পড়ছি তেমনি সন্তানরাও অজ্ঞতা বশত এ দিবসকে পালন করছে। এপ্রিল ফুল দিবসের ইতিহাস যারা জানে, তারা এ দিবসটি পালন করেনা, বরং এরকম একটি দিবস পালনকে বড় ধরণের অন্যায় বলে স্বীকার করে।
এবারে মূল কথায় আসা যাক। সাংস্কৃতিক কর্ম হিসেবে কৌতুক করেই পালন করা হয় এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি। এ দিবসটি এপ্রিল ফুল নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হলো, অখখ ঋঙঙখঝ’উঅণ. ফুল (ঋড়ড়ষ) একটি ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ বোকা। ইংরেজি এপ্রিল ফুলের অর্থ এপ্রিলের বোকা। স্পেনের তৎকালীন খ্রিস্টানরা মুসলিমদেরকে বোকা ভেবেছে বলেই নামটি এরকম। এপ্রিল ফুল সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথার প্রচলন থাকলেও সত্যকে কেউ অস্বিকার করতে পারেনা। মুসলিমপিডিয়া, জুইস এনসাইক্লোপিডিয়া ও অন্যান্য এনসাইক্লোপিডিয়া ও ইতিহাস গ্রন্থের বরাতে ড. আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়া সম্পাদিত ‘পহেলা এপ্রিল ’প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘স্পেনের অত্যাচারিত মানুষদের আহবানে সাড়া দিয়ে মুসলিম বাহিনী ৯২ হিজরী মুতাবেক ৭১১ খৃ. স্পেনে প্রবেশ করে। মুসলিমগণই ইউরোপের মানুষদেরকে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা দেন। মুসলিম স্পেনের গ্রানাডা, কর্ডোভা ও অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত। ৭১১-১৪৯২ খ্রি. পর্যন্ত প্রায় আটশত বছর স্পেন, ফ্রান্স ও পর্তুগাল মুসলমানরা শাসন করেছিল। এটি ছিল মুসলমানদের জন্য স্বর্ণযুগ। শেষ দিকে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীন কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমরা কুরআন সুন্নাহ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার মায়ায় মত্ত হয়ে নেতার নেতার নির্দেশ অমান্য করায় পারস্পিরিক শত্রুতা বেড়ে গেল। তখনই তারা স্পেন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ফলে খ্রিস্টানরা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিমদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

আজ থেকে ৫২২ বছর আগে মুসলিম অধ্যুষিত ৮৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৪৯৩ খ্রি. রাজা ফার্দিনান্ড ও রানী ঈসাবেলার যৌথ উদ্যোগে মুসলিমদের শেষ রাজধানী গ্রানাডা- দখল করতে সক্ষম হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা, রাজনীতি, স্থাপত্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখে মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য রাজা ফার্দিন্যান্ড এক ভয়ঙ্কর ফন্দি আঁটলো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানরা রাজা-রানীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এমতাবস্থায় ফাদিনান্ড ঘোষণা করেছিল যারা মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নিবে তাদেরকে নিরাপদে আশ্রয় দেয়া হবে। তার ঘোষণায় চল্লিশ হাজার মুসলমান আত্মবিশ্বাসী হয়ে গ্রানাডার মসজিদে আশ্রয় নিলেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। মসজিদের দরজাগুলো বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে মসজিদের মেঝেতে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মুসলিমদের হত্যা করেছিল রাজা ফার্দিনান্ড। ঐতিহাসিক এক বর্ণনা মতে তিন দিন পর্যন্ত হত্যাকান্ডের উৎসব চলেছিল। মসজিদের বাইরেও অসংখ্য মুসলিমকে আগুনে পুড়িয়ে, পাহাড় থেকে ফেলে, সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ ডুবিয়ে ও গণজবাই করে হত্যা করা হয়। অনেককে জোড় করে ধর্মান্তরিত করা হয়। অথচ মুসলমানরা এ রকম একটি অবস্থার জন্য প্রস্তুত না থাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেদিনে খ্রিস্টানগুরুর আদেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের মূল সূত্র লক্ষ লক্ষ আরবী পুস্তক পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। শুধু মুসলিমগণ নয়, ইয়াহূদীদের উপরও খ্রিস্টানগণ একইরূপ অত্যাচার করে। এ সময়ে রাজা ফার্দিনান্ড উপহাস করে বলেছিল, হায় মুসলমান ! তোমরা হলে এপ্রিলের বোকা। মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে বোকা বানানোর সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে এপ্রিল ফুল পালন করা হয়। অবশেষে খ্রিস্টানরা কর্ডোভার সেই ঐতিহাসিক মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করেছে। মসজিদের ভেতরে দরজা ও জানালার ফাঁকে ফাঁকে মূর্তি স্থাপন করেছে। এভাবেই মুসলিম ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। এ ঘটনা ছাড়া আরো দুটি ঘটনার কথা উইকিপিডিয়াতে উল্লেখ থাকলেও বর্ণিত ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেছেন।

এপ্রিল ফুল দিবসটি পালনের সাথে মুসলিমদের দূরতম সম্পর্ক নেই। এটি নেতিবাচক একটি কাজ। পহেলা এপ্রিল তারিখটি আসলে মিথ্যা, ধোঁকা ও প্রতারণার ব্যাপক চর্চা করতে দেখা যায়। এ মিথ্যা চর্চা থেকে বাদ যায় খুব কম সংখ্যক মানুষ। ছোট-বড়, ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষরা জীবনে একবার হলেও ধোঁকা খায়নি এমন লোক কম আছে। অন্যকে কীভাবে বোকা বানানো যায় সে চেষ্টাই করা হয়। আর ঘনিষ্টজনদেরকেই এ ধরণের কর্মকা-ের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। পহেলা এপ্রিল ভোর থেকেই বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবখানেই যেন মিথ্যা সংবাদ শোনা যায়। অতিউৎসাহীরা নিজের থেকে নানা কল্পকাহিনী তৈরী করে একে অপরে প্রচার করে। যেমন : কারো সন্তান, স্ত্রী বা ঘনিষ্ট কারও মৃত্যুর সংবাদ দেয়, ফলে সংবাদ গ্রহীতা এর দুঃখ সইতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যু বরণ করে। আবার কারো চাকুরী চলে যাওয়া, কারো স্ত্রীর ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, কারো আগুনে পুড়ে যাওয়া বা অসুখ ইত্যাদির ব্যাপারে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। এ কারণে হত্যা, তালাক ও অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকেÑ যা কখনোই কাম্য নয়।

আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, মিথ্যা ও ধোঁকা সর্বদাই পরিত্যাজ্য ও ঘৃণিত। সকল পাপের মূল হলো মিথ্যা। মহানবীর ভাষ্য মতে, যারা মিথ্যা রটায় তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মাখলুক। তাছাড়া কথা বলার সময় মিথ্যা বলা মুনাফেকের চিহ্ন। সব শোনা কথা বলাও হারাম। মুসলিম শরীফে হাফস বিন আসেম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে যা শোনবে তাই বলবে। কেহ কেহ হাসি তামাশার ছলে মিথ্যা বলাকে বৈধ মনে করেন। যা আদৌও সঠিক নয়। রানী ঈসাবেলার তথনকার মসকরা আজ ধোঁকা দিবসে পরিণত হয়েছে। রসিকতা হোক বা স্বাভাবিক অবস্থাই হোক, মিথ্যা সর্বদাই হারাম। অথচ সে রকম একটি ব্যাপারকে অজ্ঞতা বা শত্রুতা বশত মিথ্যার প্রচার-প্রচারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। পহেলা এপ্রিলের ইতিহাস সম্পর্কে ভিন্নমত থাকলেও এটি যে কোন ভাল দিক নয় তা স্পষ্ট। বর্তমান সময়েও যারা ইসলামের পক্ষে কাজ করছে তাদের উপর চলছে রিমান্ডের নামে ষ্টিমরোলার, সুস্থ অবস্থায় ধরে নিয়ে পায়ে গুলি চালানো, হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে বেধড়ক পিটুনি, এথেকে বাদ যায়নি সাধারণ নাগরিক থেকে সংবাদকর্মীরা। বুকে গুলি থাকলেও গণপিটুনির মতো মিথ্যা গল্প, আগুন দিয়ে মানুষ মারা, অস্ত্র উদ্ধার ও ক্রস ফায়ারের নামে হত্যাকান্ডের মতো সাজানো নাটক যেন ঈসাবেলার সেই যুলুমকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কোন অবস্থায় অঅমরা বসবাস করছি বিবেকের কাছে সে প্রশ্নই বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। সর্বোপরি কথা হলো, স্পেন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করা। ইসলামী জীবন বিধান ব্যক্তিজীবনে ধারণ করা। অমুসলিমদের রীতি-নীতির অনুসরণ করার বিষয়ে সতর্ক থাকা।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

Share