‘পরিবার পরিকল্পনা একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এমন অনুরোধ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’ এমন নিরুপায় অনুরোধই জানিয়েছেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এখন দয়া করে অন্তঃসত্ত্বা হবেন না- এমন নির্দেশিকা প্রচার করা হচ্ছে দেশ জুড়ে।
অবশ্য এমন আবেদনের কারণটা বেশ গুরুতর। দেশটিতে বেশ জোরালো ভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে ‘জাইকা’ ভাইরাস। মশা-বাহিত এই ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে অন্যের দেহে। এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না অন্তঃসত্ত্বারাও। ফলে মায়ের থেকে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে সদ্যোজাত সন্তানের শরীরে। পরিণতি, ‘মাইক্রোসেফালি’, যা এক ধরনের নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার বা স্নায়ুতন্ত্রে অস্বাভাবিকত্ব। এ রোগে অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম হচ্ছে শিশুর। শেষে মৃত্যু, না হয় পঙ্গু-জীবন।
এ মুহূর্তে ব্রাজিলের ২০টি রাজ্যের অন্তত ২ হাজার ৪শ মানুষ মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত। ইতোমধ্যে ২৯ শিশুর মৃত্যুও হয়েছে। ছ’টি রাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের অবস্থা সব চেয়ে খারাপ। শুধু পেরনামবুকো রাজ্যেই আক্রান্ত ৯শ জন। উত্তর-পূর্বেই প্রথমে সীমাবদ্ধ ছিল রোগটি। কিন্তু পরে রিও ডি জেনেইরো, সাও পাওলোতেও সদ্যোজাতদের মাইক্রোসেফালি ধরা পড়ে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাইক্রোসেফালি মূলত এক ধরনের স্নায়ুরোগ। অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম হয় শিশুর। শরীরের অন্য অংশের তুলনায় মাথা অনেক ছোট হয়। বয়স বাড়লেও মাথার খুলি বাড়ে না। কিন্তু বাড়তে থাকে মুখমণ্ডল। ফলে মুখ ক্রমশ অস্বাভাবিক চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে মাথা থেকে। দেহের স্বাভাবিক বাড়বৃদ্ধি ঘটে না। কথা বলার ক্ষমতাও তৈরি হয় না। বহু ক্ষেত্রে মৃত্যু হয় শিশুটির। এ পর্যন্ত ব্রাজিলে এমন ভাইরাস নিয়ে জন্ম নেয়া সব শিশুরই মৃত্যু হয়েছে।
মাইক্রোসেফালি আক্রান্ত শিশু
ব্রাজিলের পেরনামবুকো রাজ্যের শিশু চিকিৎসক আঙ্গেলা রোচার বলছেন, ‘সারা জীবন পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে বাচ্চাগুলোকে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কল্পনাও করতে পারছি না। একটা গোটা প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে থাকবে!’
ভ্রূণের মাথায় রক্ত কম পৌঁছলে বা জিনগত সমস্যায় অনেক সময় এই রোগ হয়। ব্রাজিলে কিন্তু রোগ ছড়াচ্ছে একটি ভাইরাস। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, গত মাসে এ দেশে দারুণ ভাবে মাথাচাড়া দেয় মাইক্রোসেফালি। ঘটনাচক্রে দেখা যায়, ‘জাইকা’ নামে একটি ভাইরাসেরও সংক্রমণ ঘটছে ব্রাজিলে। এর পর মাইক্রোসেফালি-তে আক্রান্ত এক শিশুর দেহের ময়নাতদন্ত করে দেখা যায়, সে জাইকা-তে আক্রান্ত হয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদে অনুসন্ধান চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন, গর্ভবতী থাকাকালীন ওই শিশুটির মায়ের শরীরে জাইকা-র সব উপসর্গই ছিল। মাঝেমধ্যে হাল্কা জ্বর, সারা গায়ে ডেঙ্গির মতো লালচে দাগ, গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা ইত্যাদি।দুইয়ে দুইয়ে চার করেন তাঁরা। পরে দেখা যায় মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত সব সদ্যোজাতের মা-ই জাইকা আক্রান্ত হয়েছেন।
জাইকা হল ডেঙ্গু, জাপানি এনসেফ্যালাইটিস, ইয়োলো ফিভার গোত্রীয় ভাইরাস। এর প্রথম সন্ধান মেলে ১৯৪৭ সালে আফ্রিকার উগান্ডায় জাইকা অরণ্যের রিসাস বাঁদরের শরীরে। মানুষের দেহে এটি পাওয়া যায় ১৯৬৮ সালে, নাইজিরিয়ায়। এর পর একে একে তানজানিয়া, মিশর, সিয়েরা লিওন, গ্যাবন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খোঁজ মিলতে থাকে ভাইরাসটির। ক্রমে আফ্রিকা থেকে এশিয়া। ভারত, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, তাইল্যান্ড,
ভিয়েতনামেও সংক্রমণ ঘটে। এ ভাবে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দায়ী করেন এডিস মশাকে। জাইকা ভয়াবহ আকার ধারন করে ২০০৭ সালে। ফিলিপিন্সের কাছে ইয়াপ দ্বীপপুঞ্জের চার ভাগের তিন ভাগ গ্রাস করে ফেলে সেটি। অন্তত ১১ হাজার বাসিন্দা আক্রান্ত হয় জাইকা ভাইরাসে। এর পর ২০১৩ সালে এটির দেখা মেলে তাহিতি দ্বীপ ও পলিনেশিয়ায়। সে বার আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি, অন্তত ২৮ হাজার।
ব্রাজিলে জাইকা বয়ে এনেছে স্নায়ুরোগ মাইক্রোসেফালি। বিজ্ঞানীদের সন্দেহ, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের শরীরে জাইকা সংক্রমণ ঘটলে সন্তান এই রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। নীরবে সেই সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে এডিস মশা। ফলে একের পর এক শিশু আক্রান্ত হচ্ছে মাইক্রোসেফালিতে। আর তাই পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে বাধ্য হয়ে প্রশাসন এমন নির্দেশিকা জারি করছে। ব্রাজিলের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (হু)। সাবধান করা হচ্ছে পর্যটকদেরও। (আনন্দবাজার)
নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট : ০১:০০ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার
ডিএইচ