এক যুগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ টন

বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে অবদানসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় ও আমিষ সরবরাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস এই মাছ। ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতিও এসেছে দেশে। জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযানসহ সরকারের নানামুখী কঠোর ব্যবস্থাপনায় গত এক যুগে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ টন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এসব তথ্য জানান।

দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ইলিশ মাছ জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন, ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’) সনদ পায়। জিআই পণ্য হওয়ায় ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি এবং নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে সমাদৃত হবে।

জানা যায়, দেশের উপকূলীয় জলাশয়ে ১০ মিটারের কম গভীরতায় ক্ষতিকর জালের ব্যবহার বিশেষ করে যথেচ্ছভাবে বেহুন্দি জাল, কারেন্ট জাল, মশারি জাল, চটজাল, টংজালের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। এতে নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের পোনা। এটি বন্ধে প্রজ্ঞাপন জারি করে ক্ষতিকর জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

২০১৬ সাল থেকে উপকূলীয় জেলায় এই আইন বাস্তবায়নে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০১৬ সালে তিনটি জেলা, ২০১৭ সালে পাঁচটি জেলা, ২০১৮ সালে ১০টি, ২০১৯ সালে ১১টি, ২০২০ সালে ১৩টি এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে ১৭টি জেলায় এ অভিযান পরিচালিত হয়। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৮৭৩ অভিযানে ১৪ হাজার ৪১৬ বেহুন্দি জাল, ১ হাজার ৬৫৩ দশমিক ৮ লাখ মিটার কারেন্ট জাল, ২০ হাজার ৯৩৩টি অন্যান্য জাল, ২০৮ দশমিক ৯৮ মেট্রিক টন জাটকা ও অন্যান্য মাছ, ৬১ লাখ টাকা ও ৪১৩ জনের সাজা হয়েছে।

২০২২ সালে ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় ১৭টি টিম চার ধাপে ‘বিশেষ কম্বিং অপারেশন’ পরিচালনা করে। এই অভিযানের আওতায় মোট ৮৮৪টি মোবাইল কোর্ট ও ৩ হাজার ৫৪৬টি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ৪ হাজার ২১৭টি বেহুন্দি জাল, ৪৬৯ দশমিক ৫২ লাখ মিটার কারেন্ট জাল এবং ১৫শ ৬২টি অন্যান্য জাল জব্দ করে জনসম্মুখে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়। জরিমানা করা হয় ২৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়া হয় ১৭৫ জনকে।

চলতি বছরও শুরু বিশেষ কম্বিং অপারেশন
বিগত বছরগুলোতে ‘বিশেষ কম্বিং অপারেশন’ জানুয়ারি মাসে ১৫ দিন পরিচালনা করা হতো। মনিটরিং কমিটি ও জেলা-উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিযান আরও ফলপ্রসূ করতে ২০২০ সাল থেকে দুই ধাপে এবং সবশেষ ২০২২ সালে চার ধাপে মোট ৩০ দিন এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ২০২৩ সালেও চার ধাপে ৩০ দিন অভিযান চালানোর প্রস্তাব করেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে প্রথম দুই ধাপের অভিযানের ব্যয় রাজস্বখাত এবং পরবর্তী দুই ধাপের ব্যয় প্রকল্প থেকে নির্বাহ করার প্রস্তাব করা হয়। এবার ৪ জানুয়ারি থেকে পরিচালিত হচ্ছে। অভিযানের নিয়মিত তথ্য সংগ্রহে মৎস্য অধিদপ্তরে চালু রয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ।

অভিযান বাস্তবায়ন এলাকা
দেশের উপকূলীয় ১২ জেলা- পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও চাঁদপুরে এবং কারেন্ট জালের উৎপাদন বন্ধে মুন্সিগঞ্জে কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে।

জেলেদের জন্য বরাদ্দ ৫৭ হাজার ৭৩৯ টন ভিজিএফ
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী জাটকা আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, বেচাকেনা ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চার মাস জাটকা আহরণে বিরত থাকা জেলেদের সরকার মানবিক সহায়তা দেয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে জাটকা আহরণে বিরত থাকা জেলেদের জন্য সরকারের মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৫৭ হাজার ৭৩৯ দশমিক ০৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

জানা যায়, জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালে দেশের ২০ জেলার জাটকা সম্পৃক্ত ৯৭টি উপজেলায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৯টি জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তার লক্ষ্যে এ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় ফেব্রুয়ারি-মে ২০২৩ মেয়াদে চার মাসের জন্য নিবন্ধিত ও কার্ডধারী জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি হারে এ চাল দেওয়া হবে। ১০ এপ্রিলের মধ্যে ভিজিএফের চাল উত্তোলন ও বিতরণ সম্পন্ন করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যেসব উপজেলায় ভিজিএফ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে
ঢাকা জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুর, মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর, শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও গজারিয়া, ফরিদপুর জেলার সদর, মধুখালী, সদরপুর ও চরভদ্রাসন, রাজবাড়ি জেলার সদর, পাংশা, কালুখালী ও গোয়ালন্দ, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও গোসাইরহাট, মাদারীপুর জেলার সদর, কালকিনি ও শিবচর, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, মীরসরাই ও চট্টগ্রাম মহানগর, ফেনী জেলার সোনাগাজী, নোয়াখালী জেলার সদর, হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর জেলার সদর, রামগতি, রায়পুর ও কমলনগর, চাঁদপুর জেলার সদর, হাইমচর, মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ, বাগেরহাট জেলার সদর, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, রামপাল, চিতলমারি, শরণখোলা ও কচুয়া, সিরাজগঞ্জ জেলার সদর, চৌহালি, বেলকুচি, কাজীপুর ও শাহজাদপুর, বরিশাল জেলার সদর, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা, বাবুগঞ্জ, বানারীপাড়া, উজিরপুর, গৌরনদী ও বাকেরগঞ্জ, পিরোজপুর জেলার সদর, মঠবাড়ীয়া, ভান্ডারিয়া, নেছারাবাদ, নাজিরপুর, ইন্দুরকানী ও কাউখালী, পটুয়াখালী জেলার সদর, কলাপাড়া, বাউফল, গলাচিপা, রাঙ্গাবালি, মির্জাগঞ্জ, দশমিনা ও দুমকি, ভোলা জেলার সদর, বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, দৌলতখান, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও মনপুরা, বরগুনা জেলার সদর, আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, বামনা ও বেতাগী এবং ঝালকাঠি জেলার সদর, কাঁঠালিয়া, নলছিটি ও রাজাপুর।

ইলিশ রক্ষা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে কর্মসূচি
বঙ্গোপসাগরের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার ইলিশের প্রধান প্রজনন এলাকা চিহ্নিতকরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে নানান ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ছয়টি ইলিশ অভয়াশ্রম স্থাপন ও অংশীদারত্বমূলক ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ, ইলিশের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণের ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ, জাটকা সংরক্ষণে জাটকা আহরণের ওপর আট মাস (নভেম্বর-জুন) নিষেধাজ্ঞা আরোপ, ভিজিএফ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ইলিশ জেলেদের জীবিকায়নের ব্যবস্থা, নির্বিচারে জাটকা নিধন বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নভেম্বর থকে জুন মাস পর্যন্ত মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন, মা ইলিশ রক্ষায় প্রধান প্রজনন মৌসুমে মোট ২২ দিন প্রজনন এলাকাসহ সমগ্র দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহন ও মজুত বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন বাস্তবায়ন, প্রতি বছর জাটকা রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপন এবং জাটকাসহ অন্যান্য মৎস্যসম্পদ ধ্বংসকারী অবৈধ জাল নির্মূলে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণমুক্ত জলাশয়, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন, ব্যবস্থাপনার জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ-বাস্তবায়নের ফলে এই অনন্য অর্জন।

‘মৎস্যখাতে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ফলে বিগত এক দশক ধরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল উল্লেখযোগ্য। মাছের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থাপনা, মৎস্য খাতে গবেষণার উন্নয়ন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশের মৎস্য খাতে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘একক মৎস্য প্রজাতি হিসেবে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ইলিশ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় এক শতাংশের অধিক। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েছে জিআই পণ্যের মর্যাদা। দেশে-বিদেশে ইলিশ মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।’

জাতীয় মাছ ইলিশ সংরক্ষণে সবাইকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইলিশের টেকসই ও সহনশীল আহরণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাটকা সংরক্ষণ, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ, ইলিশের জন্য অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনা, ইলিশ আহরণের নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, তাদের জন্য ভিজিএফ প্রদান, জাটকা রক্ষায় বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনাসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন ছিল জানিয়ে বলেন, সরকার গৃহীত ব্যবস্থাপনা ও কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ফলে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

আগামীতে সঠিকভাবে ইলিশ ব্যবস্থাপনা করা গেলে এবং পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহনশীল উৎপাদন বজায় থাকবে বলে মনে করেন মন্ত্রী।

বার্তা কক্ষ, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩

Share