মুক্তিযুদ্ধ; একটি জাতির মুক্তির গল্প। একটি নতুন স্বাধীন দেশ গড়ে ওঠার সূচনা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এমন একটি ঘটনা, যার সাথে জড়িয়ে আছে এদেশের মানুষের শত আশা-আকাঙ্ক্ষার গল্প, মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারার আকুলতার গল্প, হাজার রকম ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প। সেইসাথে আরো আছে অনেক আত্মগ্লানি এবং হতাশার গল্পও।
মুক্তিযুদ্ধের গল্পটা সবার জন্য একরকম নয়। মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর পরেও সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। এঁদের মধ্যে বীরাঙ্গনাদের অসহায়ত্ব ছিলো অবর্ণনীয়; নিজ দেশে তারা অবহেলিত, নিগৃহীত হয়ে জীবনযাপন করে গেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত এই মানুষগুলো স্বাধীনতার পরে নিজ দেশে উপেক্ষার শিকার হয়ে বেঁচে ছিলেন। এমনকি কখনো আপন পরিবারও তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। আর সামাজিক স্বীকৃতি? বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই আমাদের লেগেছে চার দশকের চেয়ে বেশি সময়; ২০১৪ সালে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এমনই একজন বীরাঙ্গনা হলেন রমা চোধুরী।
একাত্তরের সাহসী এই জননীর জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রাম এই মহিয়সী নারীর জন্মস্থান। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালীন রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার হওয়া অবহেলিত এই জনপদে একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি। তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন, পড়াশোনার বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাট চুকিয়ে শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। দীর্ঘকাল এই পেশায় যুক্ত ছিলেন তিনি। জাতিকে শিক্ষিত করার কাজে নিয়োজিত একজন নারী, সেইসাথে তিন সন্তানের জননী হয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিলো তার দিনকাল। এরপরেই আসে তাঁর জীবনের কালো অধ্যায়। সময়টা মুক্তিযুদ্ধের, যার ভয়াবহতায় একে একে সব হারান তিনি। তাঁর স্বামী পরিবারের কথা চিন্তা না করে চলে যান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। প্রবল উৎকণ্ঠায় তিনি পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায় বৃদ্ধা, অসুস্থ মা এবং তিন সন্তানকে নিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকেন।
১৩ মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাঁর বাড়িতে আক্রমণ চালায়। পাশবিক নির্যাতন চালায় তার ওপর। তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে লুকিয়ে থাকেন জীবন বাঁচাতে। তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মানুষরূপী সেই পশুরা। গান পাউডার দিয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায়।
বাড়ির একটু দূর থেকেই তাঁর মূল্যবান সাহিত্যকর্ম, কাগজপত্র পুড়তে দেখেন তিনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেননি। এরপর থেকে স্বাধীনতা লাভের সময়টুকু বৃদ্ধা মা ও তিন সন্তানকে নিয়ে বন-জঙ্গলে লুকিয়ে দিন কাটিয়েছেন। ধ্বংসাবশেষ বাড়িতে মাথার ওপর খড়কুটো বা পলিথিন দিয়ে কোনোমতে রাত পার করতেন। মুক্তযুদ্ধকালীন তাঁর এই অবর্ণনীয় কষ্টের কথাই লিখে গেছেন তাঁর ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। তাঁর ভাষায়,
“সেদিন আমাদের পাড়ায় কত মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে পিশাচগুলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যুবতী মেয়ে ও বৌ কাউকেই ছাড়েনি। গর্ভবতী বৌ, এমনকি আসন্ন প্রসবারাও বাদ যায়নি। এসব কথা জানতে পেরে আমি অন্তরের গ্লানি ভুলে নিজেকে কোনোমতে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেও মা কিন্তু আমার গর্ভে হানাদারের সন্তান আসতে পারে ভেবে আতংকে ও উদ্বেগে ছটফট করতে থাকেন।”
খাদ্যহীন, বাসস্থানহীন অবস্থায় রোগে-শোকে ভুগে পরপর দুই সন্তানকে হারান তিনি। ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ছয় বছর বয়সী সন্তান সাগরকে হারান ২০শে ডিসেম্বর। স্বাধীনতা আসতে না আসতেই যেন সন্তানের মৃত্যু দেখিয়ে দেয়, কত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত এই স্বাধীনতা। সাগরের মৃত্যুর ব্যাপারে একাত্তরের জননী বইটিতে তিনি অনুভূতি প্রকাশ করেন এভাবে,
“ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, ‘আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই’ (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।”
এর দু’মাস পরই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চার বছর বয়সী ছেলে টগরও। এরপরের সময়টা শুধুই কষ্টের। প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কাছে তিনি ধর্ষিতা নারীর পরিচয়ে উপেক্ষিত হিসেবেই থাকেন বাকি বীরাঙ্গনাদের মতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও কিছুকাল শিক্ষকতা করে জীবনযাপন করেন। তারপর শিক্ষকতা ছেড়ে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। লেখালেখির শুরুতে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখা শুরু করেন। সম্মানী হিসেবে টাকা নিতেন না, সেই পত্রিকারই পঞ্চাশ কপি নিতেন। নিজেই তা বিক্রি করে সেই উপার্জন দিয়ে কোনোমতে চলতেন। এরপর নিজেই বই লেখা শুরু করেন। নিজের লেখা বই নিজেই পথে পথে ঘুরে বিক্রি করতেন। চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিত ভিজে খালি পায়ে অনেকেই হয়তো এই বৃদ্ধাকে বই বিক্রি করতে দেখেছেন।
খালি পায়ে হাঁটার পেছনে কাজ করে তাঁর নিজস্ব আবেগ ও বিশ্বাস। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও মৃতদেহ পোড়ানোয় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই হারানো দুই ছেলেকে মাটিতে দাফন করেন তিনি। যে দেশের মাটিতে তাঁর ছেলেরা ঘুমিয়ে আছে, সেই মাটিতে জুতা পরতেই ছিলো তাঁর আপত্তি। তারপরেও কিছুদিন অনিয়মিতভাবে জুতা পরেছিলেন আত্মীয়দের চাপে।
১৯৯৮ সালে বোয়ালিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তাঁর ২১ বছর বয়সী ছেলে দীপঙ্কর টুনু। এরপর থেকে একেবারেই জুতা পরা ছেড়ে দেন তিনি।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তাঁর পদচারণা। প্রবন্ধ, ছড়া, ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, ইতিহাস, সমালোচনামূলক সাহিত্য- এসকল শাখায় লিখে গেছেন তিনি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ হলো একাত্তরের জননী, আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন, সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদের জিজ্ঞাসা, স্বর্গে আমি যাবো না, ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ, চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে জীবন দর্শন, অপ্রিয় বচন, লাখ টাকা, হীরকাঙ্গুরীয়, ১০০১ দিন যাপনের পদ্য ইত্যাদি।
তাঁর লেখা বইয়ের মোট সংখ্যা ২০। ছেলে টুনুও একজন কবি ছিলেন। ছেলের লেখা নানা সময়ের চিঠি সংগ্রহ করে ‘হৃদয়ের ভাষা’ নামে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করেন রমা চৌধুরী।
প্রবল দুঃখ দুর্দশার মধ্যে থেকেও তিনি কখনো কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। আত্মসম্মানবোধ এতটাই প্রবল ছিলো এই সংগ্রামী নারীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গণভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। একাত্তরের জননী বইটি উপহার দেন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে তিনি সবিনয়ে জানান, নিজের উপার্জনেই তিনি বেঁচে থাকতে চান।
তিনি বিড়াল খুবই ভালোবাসতেন। ‘অনন্যা’ নামের এক পাক্ষিক পত্রিকায় তাঁর জীবনে বিড়ালের ভূমিকা নিয়ে একটি গদ্য ছাপা হয়। ৮টি বিড়ালকে তিনি তাঁর ৮টি বই উৎসর্গ করেন!
২০১৭ সালে বেড়ালকে খাওয়াতে গিয়ে সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। এরপর থেকেই টানা অসুস্থ ছিলেন তিনি। হাড়ের ব্যথা ছাড়াও ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন। এসকল নানা অসুস্থতার জের ধরে গত ৩ সেপ্টেম্বর পরপারে পাড়ি জমান অসীম সাহসী ও সংগ্রামী এই একাত্তরের জননী।
একাত্তরের জননী হয়েই তিনি আজীবন এদেশের মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
ঢাকা চীফ ব্যুরো,৩০ এপ্রিল,২০২১;