আজ বুধবার ১ জুলাই গর্বের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একশ’ বছরে পা রাখলো ঢাবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম এবং বড় কোনো অর্জনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ঢাবি। নানা ঘটনার একপর্যায়ে ১৯২১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণে স্থাপিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বেলে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি। তৈরি করেছে অসংখ্য জ্ঞানী ব্যক্তি। ঢাবির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজসেবক-রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের গবেষক সংখ্যা প্রচুর। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে কর্মরতদের প্রায় অর্ধেকের বেশি ঢাবির শিক্ষার্থী।
সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষাপটে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের একটি বিশেষত্ব হলো বাংলাদেশ স্বাধীন করতে এর বিশেষ অবদান ছিল। যেখানে দেশের সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল। অদ্যাবধি যা বিশ্ব দরবারে বিরল ঘটনা।
ঢাবির শিক্ষকবৃন্দ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি পদক লাভ করেছেন। কিন্তু শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে নানা কারণে ঢাবির শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্নও তৈরি হয়েছে। তবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কয়েকজন ভাইস চ্যান্সেলর।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে বিংশশতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইস রয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি.আর. কুচলার, ড.রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি.আর্চিবল্ড,জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদরাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক এবং সংস্কৃত কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ সতীশ্চন্দ্র আচার্যকে সদস্য করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভা পাস করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’।
১৯২১ সালের ১ জুলাই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়। সে সময়কার ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যম-িত রমনা এলাকায় প্রায় ৬ শ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবনসমূহ ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাবি।
৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। ঢাবিকে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সকল জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে প্রণীত ১৯৬১ সালের আইয়ুব সরকারের জারিকৃত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ জারি করেন। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০ জন। পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৮ জন শিক্ষক।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঢাবিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও অগ্রগতিতে নিবেদিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা-কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
সাবেক ভিসিদের বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মাতৃসম প্রতিষ্ঠান আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘ঢাবি আমার মাতৃসম প্রিয় আলমামেটার। যেমনি প্রিয় তেমনি শ্রদ্ধেয়। মাতৃস্নেহের পরশমনি যেমন সন্তানকে পূর্ণতা দান করে তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের পরশমনি। আত্মপ্রত্যয় ও মর্যাদাবোধে সিক্ত করে। আমার মরহুম মা যেমন এখনো চারপাশে আছেন তেমনি ঢাবি আমার সচেতনতাকে ঘিরে প্রতিনিয়ত বিদ্যমান। ছাত্রাবস্থায় আমি ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বছরগুলো কাটিয়েছি। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও গবেষণায়, ঢাবির শিক্ষা, প্রশাসনের একক গলিতে দায়িত্ব পালন করেছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রোভিসি ও ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। দেখেছি অনেক কিছু এবং শুনেছি বেশি। কখনো হতাশ হয়েছি। কিন্তু উপভোগ করেছি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বৃহৎ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য। মনে হয়েছে এ তো আমার জীবন, সুখ-দুঃখে স্বর্ণসূত্রে গ্রোথিত আমার মুহূর্তগুলো।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি কিছু কারণে ঢাবি মর্যাদা হারিয়েছে। এজন্য দায়ী শিক্ষক-প্রশাসক উভয়ই। বিশ্ববিদ্যালয় হলো সৃজনশীলতার ভিত্তিভূমি ও মেধা চর্চার কেন্দ্রভূমি। নতুন চিন্তা-ভাবনা তৈরির মহান প্রতিষ্ঠান। আমরা জাতীয় জীবনের যেসব অর্জনকে নিয়ে গর্ববোধ করি তার সাথে ঢাবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আনয়ন ও অগ্রবর্তী চিন্তার প্রসারে এ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তুলনাবিহীন। আসছে বছরে ঢাবি শতবর্ষে পা দেবে। আশা করবো, জাতির প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে যুবশক্তির উন্নয়নে, জনজীবনে পূর্ণতা আনয়ন এবং জাতিকে ঐক্যসূত্রে বন্ধরে দায়িত্বে যথার্থ ভুমিকা রাখবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।’
সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শর্তবর্ষে পদার্পণ করছে এটি গর্ব ও আনন্দের বিষয়। ১ শ বছর ধরে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে চলেছে গর্বের প্রতিষ্ঠানটি। এক সময় এ অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ধনী-গরিব সবাইকে শিক্ষা দিচ্ছে ঢাবি। ঢাবির অবদান অনস্বীকার্য। যা স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে লেখা থাকবে। ঢাবি ও বাংলাদেশের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা আন্দোলন সহ সবকিছুতেই ঢাবির অবদান অনেক বেশি। সেসব আন্দোলনে যারা অগ্রসর জনগোষ্ঠী তারা ঢাবির শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই ছিলেন। তবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, ডিন এবং ভিসি ছিলাম। আমি জীবন্ত সাক্ষী। বর্তমানে ঢাবিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার সুনাম তো আগের মতো নেই। নানা সমস্যায় জর্জরিত। ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা বর্তমানে নষ্ট হয়েছে। তবুও ঢাবি তা আলোক মশাল জে¦লেই চলেছে। ঢাবি পরিবারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবারই উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ’
ঢাবির আরেক ভিসি অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। যা পৃথিবীর আর কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের নেই। তবে উদ্ভাবনে আমরা পিছিয়ে। র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকলেও ঢাবির মর্যাদা ও সুনাম বিশ্বের সর্বত্রই রয়েছে। ঢাবির কাছে প্রত্যাশা অনেক। সায়েন্টিফিক তথা বিজ্ঞান জগদে অনেক কিছু কাজ করার আছে। যদিও তা ব্যয়বহুল। কিন্তু বর্তমান বিশে^র অগ্রগতির সাথে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলাটাই চ্যালেঞ্জ। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গর্বের জায়গা।
প্রতিবেদক : শফিকুল ইসলাম , ৩০ জুন ২০২০ < strong>