দীর্ঘ একযুগ আগে হারিয়ে যাওয়া আদরের সন্তানকে ফিরে পাচ্ছেন চাঁদপুরের জেলে সাত্তার ছৈয়াল।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ সেপেটম্বর) দিনশেষে হয়তো বাবা-মেয়ে মুখোমুখি হবেন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের কার্যালয়ে। আর সেই আনন্দঘন সময়ের সাক্ষী হতে অপেক্ষার প্রহন গুনছেন হারিয়ে যাওয়া নার্গিস আক্তার (মনি)’স্বজনরা।
দরিদ্র জেলে সাত্তার ছৈয়াল (৭০)। আট সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসারে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না পিতা। অভুক্ত সন্তানদের মুখের দিকে তাকালেই দু’চোখ পানি চলে আসে তার।
এদের মুখে খাবার তুলে দিতে সামনে কোনো উপায়ও নেই তার। অবশেষে এক প্রতিবেশীর আবদার রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেন সবচেয়ে প্রিয় কন্যা নার্গিস আক্তার মনিকে।
দীর্ঘ একযুগ পেরিয়েছে। নানা মানুষের হাত ঘুরে অবশেষে তার সন্ধান পেলেন বৃদ্ধ জেলে সাত্তার ছৈয়াল।
অনেকদিন আগের কথা। গৃহকর্মীর কাজ পেলে মেয়ে সুখে থাকবে- জেলেকে এমন আশাই দিয়েছিলেন ওই প্রতিবেশী।
রাজধানীর এক ধনী পরিবারে কাছে তুলে দেওয়া হয় মনিকে। তখন তার বয়স মাত্র ৯। কিন্তু কয়েক মাস না পেরোতেই ভদ্রবেশী পরিবারের নির্যাতন শুরু হয় মনির ওপর। একরাতে সুযোগ বুঝে ওই বাসা থেকে পালিয়ে যায় সে। উদ্দেশ্য সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে আসবে। কিন্তু পথে আরেকজনে হাতে পড়ে মনি।
এমনভাবে কয়েকটি পরিবারের কাছে মনির আশ্রয় মিললেও নির্যাতনের হাত থেকে যেনো রেহাই নেই। কিস্তু ভালো সময়ও আসে তার জীবনে। অভাগীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বাগেরহাট পৌরসভার এক কাউন্সিলর। তিনি ঢাকায় বসবাসরত তাঁরই এক নিকটাত্মীয়ের কাছে তুলে দেন অসহায় মেয়েটিকে।
তারপর দীর্ঘ একযুগ! এখন মনির বয়স ২২। সেই কাউন্সিলর ভদ্রলোকের আত্মীয় পরিবারটি জানতে পারে, মেয়েটির গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। অবশেষে তারা চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের মাধ্যমে মনির বাবা-মায়ের সন্ধান চান। মাত্র মাস দেড়েক আগেই চাঁদপুরে যোগ দিয়েছে জিহাদুল কবির।
শুরু হয় নাটকীয়তাপূর্ণ বাস্তবতার দৃশ্যায়ন। পুলিশ সুপারের নির্দেশমতে চাঁদপুর সদর থানার ওসি (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান মোল্লা তথ্য নেন মনির কাছ থেকে। তিনি ছুটে যান সদর উপজেলার হরিণাঘাট এলাকায়। সেখানকার ইউপি সদস্য হাসান শেখের সহায়তায় মোট ১২ জনকে হাজির করা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। এদের সবার নাম সাত্তার। কিন্তু ফল মেলেনি। এদের কেউ-ই তার সন্তান হারিয়েছে বলে দাবি কারেননি। হাল ছাড়লেন না পুলিশ সুপার।
আবারো ওসি (তদন্ত)-কে হরিণাঘাটে পাঠান। তবে এবার সন্ধান মিলেছে আরেক সাত্তারের। যিনি নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু বসতবাড়ি নদীতে ভেঙে গেলে তিনি চলে গেছেন মেঘনা নদীর পশ্চিমে জেগে উঠা নতুন একটি চরে। সেখানেই যান ওসি মাহবুব।
এবার নাটকের ক্লাইমেক্স। এই সেই সাত্তার ছৈয়ালের সন্ধান মিলল, যার সন্তানের খোঁজ নেই সেই কবে থেকে!
বৃহস্পতিবার সকালে তাকে নিয়ে হাজির করা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। মোবাইল ফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবা-মেয়েকে উপস্থাপন করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বাবা-মেয়ের কান্নায় অনেকের চোখে পানি চলে আসে। দুই প্রান্তে উপস্থিতরা আনন্দে ভাসেন, যেন সুখের মিলনের মাধ্যমে সিনেমার যবনিকা টানা হচ্ছে।
ইউপি সদস্য হাসান শেখ বলেন, ‘মনিকে হারিয়ে শোকে কয়েক বছর আগে মা আমেনা বেগম মারা যান। তিনি আরো জানান, সন্তানকে ফিরে পেতে কতই না মানত-নিয়ত করেছিলেন ওই বৃদ্ধা।’
পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির জানান, ‘আজকের দিন শেষে হয়তো বাবা মেয়ের সাক্ষাৎ ঘটবে। মুখোমুখি হবেন তারা। ইতিমধ্যে নার্গিস আক্তার মনিকে চাঁদপুরে নিয়ে আসতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন তিনি।’
করেসপন্ডেট