মধ্যরাত। কনকনে শীত। কুয়াশাচ্ছন্ন। একটি বাচ্চা কুকুরের গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে তাঁর কানে। তখনই ঘুম থেকে উঠে জনমানবহীন রাস্তায় নেমে তিনি দেখেন, পানিভর্তি গর্তে একটা কুকুরের বাচ্চা ছটফট করছে। বুকসমান সেই পানিতে নেমে তাকে উঠিয়ে বাসায় নেন। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় এভাবে বেঁচে যায় সেই বাচ্চা কুকুর।
কয়েক মাস আগে তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে খবর দেন, বাসের ধাক্কায় একটি কুকুরের পা ভেঙে গেছে। রাস্তায় সেই কুকুরটি যন্ত্রণায় ছটফট করছে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে সেখানে ছুটে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে সোজা চলে যান পশু হাসপাতালে।
নিজের খরচে চিকিৎসা করিয়ে তাকে নিয়ে ফেরেন বাসায়। ভোরের আলো ফোটার আগে আর বিকেলের সূর্য যখন বিদায় নেয়, তখনই বাসা থেকে খাদ্যভর্তি থলে নিয়ে বের হন। নিজের হাতে এলাকার রাস্তার সব কুকুর-বিড়ালকে খাইয়ে বাসায় ফেরেন।
যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন, ঠিক তখন থেকে বছরের পর বছর রাস্তার প্রাণীদের এভাবে খাওয়াচ্ছেন। কোনো প্রাণী হারিয়ে গেলে তার খোঁজে নিজে মাইকিং করেন, দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেন লিফলেট। খুঁজে পেলে আনন্দে আত্মহারা হন আর না পেলে সেই বেদনায় কাতর হয়ে নীরবেই শুধু কাঁদতে থাকেন। প্রাণীপ্রেমী এই মানুষের নাম সোহান জাহান। থাকেন রাজধানীর স্বামীবাগ এলাকায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই নারী এখন টিকাটুলির একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষক।
সোহানের বাবা মোহাম্মদ আবু তরি ছিলেন বিভিন্ন জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। প্রাণীদের খুব ভালোবাসেন তিনি। সোহান যখন ছোট, তখন তিনি বাসায় নিয়ে আসতেন বিভিন্ন প্রাণী। বাসায় পুষতেন কুকুর ও বিড়াল। একবার বাবা বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসেন ছোট্ট এক বানর।
সেই বানরের সঙ্গেও সোহানের খুব বন্ধুত্ব হয়। তাঁকে সে গোসল করাতেন। খাওয়াতেন। প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটাতে তাঁর খুব ভালো লাগত। ধীরে ধীরে তাদের আবেগ, ভাষা যেন বুঝতে পারতেন। সোহান জাহান এখন প্রাণীদের দৃষ্টি দেখে বুঝে ফেলেন, তারা কী চায় তাঁর কাছে। একদম ছোট্টবেলায় রাস্তায় দেখতেন, খাওয়ার জন্য কুকুর, বিড়ালকে কত কষ্ট করতে হয়। অকারণে তাদের দিকে ঢিল ছোড়া হয়। আর দুর্ঘটনায় পড়া কুকুর-বিড়াল রাস্তায় ছটফট করছে। প্রাণীদের প্রতি মানুষের এমন আচরণ সোহান জাহানের শিশুমনকে ভীষণ কাঁদাত। তখন থেকেই তিনি ঠিক করেন, রাস্তার প্রাণীদের খাওয়াবেন।
শুরু থেকেই বাবা তাঁকে সাহায্য করেন। মাঝেমধ্যে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার কুকুরকে খাওয়াতেন সোহান। এভাবে প্রাণীদের খাওয়ানো তাঁর রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তবে এ জন্য নানা বাধার মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাঁকে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা রাস্তায় একটি মেয়ে কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াচ্ছেন—এটা এলাকার অনেকে পছন্দ করেনি।
যখন তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, তখন তাঁকে শুনতে হয় নানা আজেবাজে কথা। রাস্তার প্রাণীদের যাতে তিনি না খাওয়াতে পারেন, সে জন্য তাঁর কুকুরকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁকে জীবননাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা চেয়ে তিনি কয়েক মাস আগে ওয়ারী থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন। এত বাধা, এত হুমকির পরও আপন পথে হেঁটে চলেছেন সোহান জাহান।
লেখাপড়া শেষ করার পর একটি ভালো ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন তিনি। নয়টা-পাঁচটা অফিস করতে গিয়ে দেখলেন, আগের মতো সকাল-সন্ধ্যা প্রাণীদের খাওয়াতে পারছেন না। বেশি বেতনের চাকরি করবেন নাকি প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটাবেন—এই দ্বন্দ্বে পড়েন তিনি। জয়ী হয় প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা। আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির কাছে ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলের চাকরি নেন সোহান। সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সেখানে সময় দেন। বেতনের টাকা দিয়ে প্রাণীদের জন্য খাবার কেনেন।
রাস্তার প্রাণীদের প্রতি সোহান জাহানের ভালোবাসার খবর এলাকার সবাই জানেন। তাই কোনো কুকুর বা বিড়াল দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁকে এলাকার অনেকে খবর দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে সেই প্রাণীর প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। কয়েক মাস আগে তাঁর এলাকার একটা কুকুর হারিয়ে যায়।
সেই কুকুরটিকে খুঁজে পেতে সোহান নিজে স্বামীবাগ, টিকাটুলিসহ আশপাশের এলাকায় মাইকিং করেন। সায়েদাবাদ বাসস্টেশনসহ আশপাশের এলাকায় সেই কুকুরের ছবিসহ অনেক পোস্টার দেয়ালে লাগান। কুকুরটিকে খুঁজে পাওয়া গেলেও পরে আবার সেটি হারিয়ে গেছে। এ নিয়ে তাঁর অনেক দুঃখ। তাই সেই কুকুরটির ছবি তাঁর ওয়ালেটে রেখেছেন।
প্রাণীদের প্রতি কেন এত ভালোবাসা? সোহান জাহান বললেন, ‘প্রাণীরা নিষ্পাপ। অন্যায় করে না। স্বার্থপর নয়। আঘাত পেলে যেমন মানুষের খারাপ লাগে, ঠিক তেমনি আঘাত পেলে প্রাণীদেরও খারাপ লাগে। রাস্তার কুকুর-বিড়ালের সামনে মানুষ কত ভালো ভালো খাবার খায়। এরা চেয়ে চেয়ে দেখে। এক দিন খায়, তিন দিন না খেয়ে থাকে। মানুষ অকারণে তাদের ঢিল মারে, উত্ত্যক্ত করে। অসুস্থ হলে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এসব কারণেই তাদের প্রতি মমতা জেগে ওঠে।’
কোনো প্রাণী অসুস্থ হলে সোহান জাহান তাকে নিয়ে যান গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালে। হাসপাতালের সবাই তাঁকে একনামে চেনেন। সেখানকার চিকিৎসক মাকসুদুল হাসান হাওলাদারও সোহান জাহানের প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ।
তারপরও কিছু মানুষ সোহান জাহানের এই কাজ ভালোভাবে দেখে না। সোহান বলেন, ‘ওই মানুষদের কথা শুনলে আমার চলবে কেন? আমি যদি সেসব কথা শুনে পিছিয়ে যাই, তাহলে প্রাণীরা তো আমাকে হারাবে। ওদের পাশে থাকার কেউ নেই। আমি এখন যেমন আছি, তেমনই থাকতে চাই।’
সোহান জাহানের একটা স্বপ্ন আছে। আর সেটি হলো ব্যক্তিগতভাবে রাস্তার প্রাণীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা। (প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১: ০০ এএম, ৩০ আগস্ট ২০১৭, বুধবার
ডিএইচ