বাংলাদেশে করোনা রোগীদের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান হাসপাতাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। আর এই হাসপাতালের যে বিভাগের ওপর প্রতিদিন সবার নজর থাকে সেটা হচ্ছে আইসিইউ বিভাগ। যেখানে মুমূর্ষু রোগীরাই জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে ভর্তি হয়। এখান থেকে ফেরা অনিশ্চিত। যাদের ভাগ্য ভালো তারা ফেরত আসেন আর যাদের দুর্ভাগ্য তাদের স্থান হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে দেশের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র কুর্মিটোলা হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি ও আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করে যাওয়া মানুষদের জন্য আড়াই মাস ধরে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন এই চিকিৎসক। কখনো শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে না পারলেও ফোনে কানেক্ট থাকতে হয় দিনরাত যেকোনো সময়। করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজেও আড়াই মাস ধরে রয়েছেন সেলফ আইসোলেশনে। এই আড়াই মাসে একবারের জন্য নিজের দুই সন্তানকে কাছে টেনে নিতে পারেননি। কাছে বসে খবর নিতে পারেননি স্ত্রীর।
৫২ বছর বয়সী ডা. শাহজাদ হোসেনের নিজেরও রয়েছে হার্ট, ডায়াবেটিস এবং হাইপার টেনশনের সমস্যা। এতগুলা সমস্যা নিয়ে দিনরাত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ইচ্ছে করলেই নিজের অসুস্থতার কারণে তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু দেশ এবং জাতির কথা ভেবে পিছু হঠেননি। বরং এই যুদ্ধে লড়ছেন একজন প্রধান যোদ্ধা হিসেবে।
ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুমের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার মুনসুরনগর ইউনিয়নের সরখরনগর গ্রামে। ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি ও আইসিইউ বিভাগের প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। করোনার মধ্যে নিজের দায়িত্ব পালনসহ নানা বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. শাহজাদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী একটি বাহিনীতে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনিও ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা। আড়াই মাস ধরে আমি বাসার আলাদা একটি রুমে আইসোলেশনে থাকি। ডিউটি থেকে ফিরে এই রুমে নিজেকে বন্দী করি। আমার দুইটি ছেলে আছে-একজন মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, অন্যজন ক্লাস নাইনে পড়ে। আমার বড় ছেলেটার অ্যাজমা রয়েছে। যতটুকু সম্ভব সতর্ক থেকে চলতে হয়। আড়াই মাসে আবার বাচ্চাদের গায়ে একবার হাত রাখতে পারিনি। কাছে বসে কথা বলতে পারিনি। স্ত্রী আমার রুমের সামনে খাবার রেখে দেন। আমি সেটা নিয়ে এসে খাই-এটুকুই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত।’
‘৯১ বছর বয়স্ক বাবার শারীরিক খবর সশরীরে নিতে পারিনি আড়াই মাস ধরে। নিজের কাপড় থেকে বাসনপত্র ধোয়া-সব নিজে করি। দেশের জন্য পরিবার থেকে একটু দূরত্ব রাখলেও সেটা খারাপ লাগার কিছু নেই।’
নিজে হার্ট, ডায়াবেটিস এবং হাইপার-টেনশনের রোগী হয়েও কেন নিজেকে এমন ঝুঁকিতে রেখেছেন-জানতে চাইলে ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ‘আমার বয়স ৫২, এনজিওগ্রাম হয়েছে, ডায়াবেটিকস আছে এবং আমি হাইপার-টেনশনের রোগী-এই সব গত কয়েক বছর ধরেই। সরকার যখন প্রথম বলেছিল, ৫০ বছরের ওপরের যারা তারা সরাসরি রোগীর কন্টাক্টে না গেলেও চলবে এবং পরবর্তীতে যখন বলা হলো যারা হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিস বা অন্যরোগে ভুগছেন তাদের যেহেতু রিস্ক বেশি, তাদেরও সরাসরি করোনা রোগীর কন্টাক্টে যেতে হয় এমন দ্বায়িত্ব প্রয়োজন নেই । তখন আমার কাছে সুযোগ ছিল পিছিয়ে আসার। একটা আবেদন করলে সরকার আমাকে সেই সুযোগ দিত কিন্তু আমি দুইটির কোনোটিতেই আবেদন করেনি। আমার মনে হয়েছিল এখন সময় সাহস রাখার, সাহস দেয়ার।’
প্রথমদিকে চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার প্রথম দিকে যখন অচেনা এই রোগের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আমাদের মাঝে অজানা আতঙ্ক ছিল, অজানা ভয় ছিল। সেসময় আমার বিভাগের জুনিয়ররাও মানসিক চাপে ছিল। একদিন সবাইকে নিয়ে বসলাম, সাহস দিলাম। তারা বলল, আমরা লড়াই করব শুধু আপনাকে আমাদের পাশে থাকতে হবে স্যার। যখন জুনিয়ররা এই কথা বলে তখন এমন মহামারির একটি প্রধান হাসপাতালের একটি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।’
‘আমার পেশার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ এবং দায়িত্ব মানুষের পাশে থাকার। তার ওপর এটাই দেশের প্রধান করোনার হাসপাতাল। এমন সময় আমি এভাবে দূরে যেতে পারি না। আমি যদি তখন নিজের অসুস্থতা দেখিয়ে সরে যেতাম আমার জুনিয়রদের মানসিক অবস্থা কী হতো? কারণ শুরুর দিকে সবাই মানসিকভাবে ভয়ে ছিল। এখন যদিও অনেকটাই স্বাভাবিক’-যোগ করেন ডা. শাহজাদ হোসেন।
আইসিইউতে রোগী ভর্তি এবং মৃত্যুর বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অভিজ্ঞ দেশগুলোর আইসিইউ বিভাগ থেকে অভিজ্ঞতা নিচ্ছি। ফোন, ভিডিও কনফারেন্সসহ নানা বিষয়ে কথা বলছি। সারা বিশ্বে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের আইসিইউতে যখন নেয়া হয় তখন তাদের অবস্থা খুব খারাপ থাকে। যেহেতু এখানে আসেই মুমূর্ষু রোগী। তাই চান্স থাকে ৫০/৫০। তবে অনান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা বলতে পারি, আমাদের আইসিইউ থেকে প্রতিদিন রোগীরা স্বাভাবিক হয়ে সাধারণ বেডে ফেরত যাচ্ছেন। আমাদের কাজে আমরা তৃপ্ত।’
ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি নিজে ডাক্তার হলেও সবার আগে আমি মানুষ। মানুষ হিসেবে আমারও মন রয়েছে, আবেগ রয়েছে। যখন কোনো রোগী মারা যায় খুব খারাপ লাগে। যদি কোনো রোগীর আমাদের এখানে মৃত্যু হয়, তার ঠিকানা সরাসরি আজিমপুর কবরস্থান। তাদের সবার পরিবার রয়েছে। কেউ পরিবারের প্রধান, কেউ ভাই, কেউ মা, কেউ বাবা। যখন কোনো ইয়াং ছেলে মারা যায় মনে হয়, তার জীবনের সব কিছুই বাকি ছিল। হয়তো পরিবারের একমাত্র ভরসা সে ছিল।’
‘আবার যখন বৃদ্ধ কেউ মারা যায় তখন অন্য ধরনের খারাপ লাগে যে, সারাজীবন যে পরিবারের জন্য তিনি কাটালেন, বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে গেলেন, শেষ সময়ে পরিবারের কেউ আর দেখতে পারবে না! একটু গোসল নিজের হাতে করাতে পারবে না! আসলে প্রতিটা মৃত্যুই কষ্টের। আমার চিকিৎসা জীবনে এই বৈচিত্র আর আসেনি। এই কান্না এই হাসি। কেউ মারা গেলে যেমন কান্নার জল দেখি তেমনি কেউ সুস্থ হলে তার পরিবারের যে উচ্ছ্বাস দেখি তা আনন্দ দেয়।’
কোভিড-১৯ এত সহজে যাবে না জানিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমার ধারণা, কোভিড-১৯ এত সহজে আমাদের ছেড়ে যাবে না । অনেক দিন থাকবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এখন যারা মারা যাচ্ছেন প্রাথমিকভাবে ফুসফুসের সংক্রমণে মারা যাচ্ছেন-এটাই মনে হচ্ছে। তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না (করোনা কখন চলে যাবে)। কারণ প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। আরও গবেষণা হবে। তখন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।’
চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কোভিড অনেকদিন থাকবে সেই মানসিক প্রস্তুতি ডাক্তারদের নিতে হবে। কোভিড থাকলেও অন্য রোগ আর কমবে না। হার্ট, কিডনি, প্রেগনেন্সিসহ বিভিন্ন রোগের রোগীরা যেন চিকিৎসা পায়, সেজন্য নিজের সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নিরাপত্তা ঠিক রেখে ডাক্তারদের সঠিক নির্দেশনা মেনে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই সঙ্গে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। কোভিডের বড় শত্রু মানসিকভাবে ভয় পাওয়া। তাই যার যে কাজ শখের বা ভালো লাগে তা করতে হবে। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। সেটা হতে পারে বই পড়া, গান শোনা, বাগান করা বা অন্য কিছু।’
প্রতিদিন এত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই দেখে নিজে ভয় পান কি-না জানতে চাইলে ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, প্রথম দিকে আমাদের সবার মধ্যে একটা অজানা ভয় ছিল। কারণ রোগটা নতুন। দিনে দিনে সেই ভয় কেটেছে। আমরা মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়েছি। আমরা যত দেখেছি চিকিৎসা নিলে কোভিড রোগ ভালো হয় তখন সবাই মানসিক শক্তি পাচ্ছি। তবে এটাও জানি, যেকোনো মুহূর্তে আমি আক্রান্ত হতে পারি এবং চিরদিনের মতো চলে যেতে পারি। যদি তা-ই হয় তবে আমার শুধু একটি শেষ চাওয়া আছে। ইতোমধ্যে আমার গ্রামের মানুষদের সেটা জানিয়েছি। আমরা পত্রিকায় দেখেছি, অনেক জায়গায় করোনা আক্রান্তের লাশ দাফন করতে দেয়া হয় না। সে কারণে আগেই গ্রামবাসীকে জানিয়েছি। যদিও আমার বিশ্বাস, আমার এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে।
‘আমাদের পারিবারিক যে কবরস্থান রয়েছে সেখানে যত গাছ আছে তার বেশিরভাগ আমার হাতে লাগানো। যখন আমি এই গাছগুলো লাগাই বা পরিচর্যা করতাম, তখন আমার কেন যেন মনে হতো, আমাকে কি এখানে কবর দেয়া যাবে? নাকি অন্য কোথাও? কারণ পৃথিবীতে এমন কিছু মৃত্যু আছে লাশই পাওয়া যায় না। আবার লাশ বিকৃত হয়ে যায় আবার কখনো লাশ আনাই যায় না ইচ্ছেমতো। করোনায় যারা মারা যান তাদের বেলায় সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে-পরিবারের কাছে না দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় দাফন করা হয়।’
‘পারিবারিক কবরস্থানে গাছ লাগানোর সময় যে শঙ্কা মনে কাজ করত করোনার সময়ে এই শঙ্কাটা শুধু কাজ করে যে, আমি কি আমার মার পাশে শায়িত হতে পারব? গ্রামবাসী কি দাফন করতে দেবে? তাই আমার অনুরোধ, যতদিন করোনা আছে এবং জীবিত আছি, আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাব। শুধু যদি কোনো কারণে মারা যাই আমাকে যেন আমার মা-বাবার পাশে কবর দেয়া হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার আমার প্রিয় সেই সবুজ-শ্যামল গ্রামে। যে গ্রামের কাছে আমি চিরঋণী। তার আলো-বাতাস আমাকে বড় করেছে।’
‘তবে আমার বিশ্বাস, আমার গ্রামের মানুষ না করবে না। কারণ তারা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে এবং যখনই যেখানে আমার তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বা হয়, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে আমার প্রিয় গ্রামবাসীর পাশে থাকা চেষ্টা করেছি।’
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালকের প্রশংসা করে ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, পরিচালক মহোদয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের প্রেরণা যোগায়। তিনি সেই শুরু থেকে সপ্তাহে সাতদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। তার নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতার কারণেই আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি। আর আমার সহকর্মী চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফদের অক্লান্ত পরিশ্রমই আমার শক্তি। (জাগো নিউজ)
বার্তা কক্ষ,১ জুন ২০২০