সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। এটি বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার হলের ছবি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেখানে একটি টেবিলে একগুচ্ছ ফুল রাখা। ফুলের ওপরে কাগজে লেখা ‘শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ’।
ছবিটি ‘বিএএফ শাহীন কলেজ ফ্যাক্টস’ নামক একটি গ্রুপ থেকে শেয়ার দিয়ে লেখা হয়েছে, শহিদ আহনাফ; স্বৈরাচার পতনের পর পুনরায় শুরু হলো একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা। দেশের স্বার্থে তার এই আত্মত্যাগ বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকা ও বাংলাদেশ আজীবন মনে রাখবে।
১৭ বছর বয়সি শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে নিহত হন। পরদিন দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রোববার থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সরকার।
কিন্তু আন্দোলন শেষে রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজে আহনাফের সকল সহপাঠী ক্লাসে-পরীক্ষার টেবিলে ফিরলেও ফেরেনি আন্দোলনে বুলেটবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো আহনাফ। আহনাফের টেবিলটা আজ ফাঁকা। তার স্মরণে শিক্ষকরা সেখানে ফুল রেখেছেন। আহনাফের শোকাহত বন্ধুরা তাদের প্রিয় সহপাঠীকে ভুলে নাই, কখনো ভুলতে পারবে না।
আহনাফ তার পরিবারের সদস্যদের বলতো, বড় হয়ে এমন কিছু করবে, যার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে গর্ব করবে। তবে আহনাফের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এভাবে তারা গর্বিত হতে চাননি। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আহনাফ। ২০২৫ সালে তার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল আহনাফ। আন্দোলনে অংশ নিয়ে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে আহত হয়ে সে একবার বাসায় ফিরেছিল। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে আহনাফ তার মা আর খালাকে বলত, তোমাদের মতো ভীতু মা-খালাদের জন্য ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে তোমাদের মতো মা-খালারা থাকলে দেশ আর স্বাধীন হতো না।
আহনাফের মা সাফাত সিদ্দিকী ও খালা নাজিয়া আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, আন্দোলনে যেতে বাধা দিলেই আহনাফ বলত, সে সাঈদ-মুগ্ধ ভাইদের মতো সাহসী হতে চায়। তাদের মতো কিছু হলে তারা গর্ব করে বলতে পারবেন, ‘আমরা আহনাফের মা-খালা’। শেষ পর্যন্ত আহনাফ হয়েছেও তাই।
এদিকে ‘বিএএফ শাহীন কলেজ ফ্যাক্টস’ থেকে শেয়ার দেওয়া এই ছবিটি অনেকেই শেয়ার দিচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মী রাফসান গালিব ছবিটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘সবাই ফিরেছে ক্লাসে, পরীক্ষার টেবিলে। ফিরে নাই শুধু শহীদ আহনাফ। এ দৃশ্য এতদিন আমরা ফিলিস্তিনে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। স্কুলের সহপাঠীরা সবাই ফিরেছে, যে বন্ধু ফিরে নাই তার টেবিল ফাঁকা, সেখানে তার নাম লেখা কিংবা ফুল রাখা।
হাসিনা রেজিমের কল্যাণে এমন দৃশ্য বাংলাদেশেও দেখতে হইল। আমরা ভাবতেও পারি নাই, গাজায় একের পর এক গণহত্যা নিয়ে দেখতে দেখতে একদিন আমাদেরও একটা গণহত্যা সইতে হবে। রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লব শেষে সবাই ফিরেছে কলেজে। শুধু শফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহনাফ ছাড়া।
আহনাফের টেবিলটা আজ ফাঁকা। তার স্মরণে সহপাঠীদের ফুল রাখা সেখানে। তারা তাদের শহীদ বন্ধুকে প্রিয় ভাইকে ভুলে নাই, ভুলতে পারবেও না। ফুল হয়েই আহনাফ আজ একাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় অংশ নিল। আহা, ক্লাসের বা পরীক্ষা হলের টেবিল চেয়ার নিয়ে আমাদের কত টানাটানি থাকত। এটারে জড় বস্তুই মনে হইত না তখন।
সত্যি যদি জড় বস্তু টেবিলের প্রাণ থাকত, আহনাফের এই শূন্যতা, এই ফুলের তোড়ার ভার কীভাবে সইত! ভাই, তুই বাংলা মায়ের বুকে আদরে থাক। মমতায় থাক আমাদের অম্লান স্মৃতি হয়ে। বেঁচে থাক বিপ্লবী আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে।
চাঁদপুর টাইমস ডেস্ক/ ১৮ আগস্ট ২০২৪