মাছের রাজা ইলিশের ভরা মৌসুম এখন। সাগর ও নদীতে ব্যাপক হারে মেলার কথা বাংলাদেশের জাতীয় এ মাছের।
বাজারও সয়লাব হয়ে দাম থাকার কথা হাতের নাগালে। কিন্তু চলতি বছর পরিস্থিতি ভিন্ন। বাজারে প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেলেও চড়া দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। তাই সাধ থাকলেও সাধ্যের কারণে মাছটির স্বাদ নিতে পারছেন না সাধারণ ক্রেতারা।
শনিবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়।
ছোট আকারের ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৯০০ টাকা; ৪০০ গ্রাম ওজনের ১০০০ থেকে ১০৫০ টাকা। ৫০০ গ্রাম ওজনের মাছের কেজি ১২০০ টাকা; ৬০০ গ্রাম ওজনের ১৫০০ টাকা। ৭০০ গ্রাম ওজনের মাছের কেজি ১৬০০ টাকা; ৮০০ গ্রাম ওজনের ১৭০০ টাকা। ৯০০ গ্রাম ওজনের মাছের কেজি ১৮০০ টাকা, এক কেজি ওজনের দাম ১৭৫০ থেকে ১৯০০ টাকা।
এক কেজি ১০০ গ্রাম ওজনের মাছের কেজি ১৮৫০ থেকে ২৩০০ টাকা। এক কেজি ২০০ ও ৩০০ গ্রাম ওজনের মাছের কেজি ২৫০০ টাকা। দেড় কেজি ওজনের দাম ২৪০০ থেকে ৩০০০ টাকা। দুই কেজি ওজনের মাছের কেজি ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা।
গত ২৩ জুলাই বঙ্গোপসাগরে জেলেদের ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় এখন বাজারে ব্যাপক হারে ইলিশ মাছ পাওয়া যাওয়ার কথা। উল্টো সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় সে অনুপাতে মিলছে না ইলিশ। ফলে দাম আকাশছোঁয়া বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে ইলিশ কিনে এনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন মো. মাসুদ। এ মাছের বাড়তি দামের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্ষাকালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও এবার নদীতে মাছ নেই। সাগরের মাছও আসছে না। যে কারণে বাজারেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এই মাছ তো আর চাষ করা যায় না, প্রাকৃতিকভাবে আসে। সাগরের মাছ এলে তখন দাম কমবে।
একই কথা বলেন বকুল চন্দ্র দাস নামের অপর বিক্রেতা। তিনি বলেন, এবার নদীতে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না। ১৫ দিন আগেও বাজারে ইলিশের দাম কম ছিল। কিন্তু এখন সরবরাহ নেই। তার উপর ইলিশ ধরার খরচ, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ইলিশের দাম একটু বেশি।
মো. শুক্কুর আলী নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, চাঁদপুরের আড়তে আমাদের দাদন দেওয়া আছে। সেখান থেকে আমরা মাছ আনি। এবার সাগর-নদীতে মাছ নেই। জেলেরা ৪-৫ দিনের জন্য সাগরে মাছ ধরতে যায়। খরচ পড়ে ৮০ হাজার টাকা। অথচ মাছ পায় ৫০-৬০ হাজার টাকার। তাহলে কম টাকায় তারা বিক্রি করবে কীভাবে? আর তারা মাছের দাম কম না রাখলে আমরাই বা ক্রেতাদের কাছে কম টাকায় কীভাবে মাছ বিক্রি করবো? দাম কম হলে আমাদেরই সুবিধা। বেশি বিক্রি হয়, বেশি লাভ হয়।
এখন আর বর্ষাকালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে না দাবি করে তিনি আরও বলেন, পরিবেশ-প্রকৃতি ঘুরে গেছে। এখন বর্ষাকালের জায়গায় শীতকালে ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়ে।
এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায়, তার ৮০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১ শতাংশ। তারপরও এবার ভরা মৌসুমে দেশের বাজারে ইলিশ নেই। যা ধরা পড়ছে সেটাও দামের কারণে মুখে তুলতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
কারওয়ান বাজারে মাছ কিনতে আসা খোরশেদ আলম আক্ষেপ করে বলেন, এই মৌসুমে এখনও ইলিশ মাছ মুখে তুলতে পারিনি। বাজারে ইলিশের আকাশছোঁয়া দাম। বিক্রেতারা বলছেন, নদীতে মাছ নেই। কিন্তু আমরা মনে হয় ইলিশের দাম বাড়ার ৭০ শতাংশ কারণ সিন্ডিকেট। বাকিটা হয়তো সরবরাহ কম হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, ভারতের মানুষ বর্ষার শুরু থেকে কম দামে ইলিশ খাচ্ছে। অথচ আমরা ইলিশ খেতে পারছি না।
খালেদ মাহমুদ নামের আরেক ক্রেতা বলেন, এখন ইলিশ দাম হওয়ার কথা সবচেয়ে কম। কিন্তু এখনই সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এই মাছ। ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি মাছ কিনতে হয়েছে ৯০০ টাকায়। ১৫০০ টাকা করে কেজি। কিন্তু এই মাছটির দাম হওয়া উচিত ছিল ৪০০ টাকা। দামের কারণে বিত্তবানরাই ঠিকমতো ইলিশ খেতে পারছে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের তো খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
রোমানা আফরোজ নামের এক গৃহিণী বলেন, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার ইলিশের দাম দ্বিগুণ। সাধ থাকলেও ইলিশ কেনার সাধ্য হচ্ছে না। অথচ প্রায় সময়ই খবরে দেখি আমরা ইলিশ আহরণে প্রথম অবস্থানে আছি।
ইলিশের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা যেসব কারণ বলছেন, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি কামাল হোসেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দাম কমবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। কামাল বলেন, বাজারে যে পরিমাণ ইলিশের চাহিদা, সেই তুলনায় সরবরাহ একেবারেই কম। এই জন্য ইলিশের দাম এখন একটু বেশি। দুই একদিনের মধ্যে সরবরাহ বাড়লে তখন দাম কিছুটা কমবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না, বিক্রেতাদের এই কথার সঙ্গে আমি একমত। আমাদের উপকূলে এত পরিমাণ অবৈধ জালের ব্যবহার, দূষণ ও বাঁধ, ব্যারেজ ইত্যাদি নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে পলি জমে ডুবো চরের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ডুবোচর ও অবৈধ জালের কারণে সাগর থেকে যে পথ দিয়ে মাছ নদীতে আসবে সেখানে বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে নদীতে মাছ কম আসছে। এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতেও মাছ আসা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, ইলিশের মূল মৌসুম এখনই। কিন্তু এখন সাগরের আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। নদীতেও কম পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইলিশ না পাওয়া যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন। ফলে যে সময়ে ইলিশ পাওয়া যাওয়ার কথা, সেই সময়টি পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই সময় আবার ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যে কারণে বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা কম।
গত ২৩ জুলাই সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠেছে। আমাদের দেশের জেলেরা এর আগে ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। কিন্তু ভারতের জেলেরা ১৪ জুনের পর থেকে মাছ ধরতে সাগরে যেতে পেরেছে। যে করণে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে ইলিশ মাছের দাম কম। কারণ তারা ৪০ দিন তারাই মাছ ধরেছে। যেখানে আমাদের জেলেরা মাছ ধরতেই পারেনি। এটি আমাদের জেলেদের প্রতি একটি অন্যায়।
তাই ইলিশের প্রাপ্যতা বাড়াতে দখল ও দূষণের হাত থেকে উপকূলকে বাঁচানো, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ইলিশ ধরা, খাওয়া ও বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ এবং ভারত ও বাংলাদেশের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় একই করার পরামর্শ দেন তিনি।
টাইমস ডেস্ক/ ১২ আগস্ট ২০২৩