করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে চাঁদপুরের প্রবাসীদের মাঝে। ধার-দেনা করে বিদেশে অবস্থান করলেও অনেকের পক্ষে সেই টাকা আয় করা সম্ভব হয়নি। করোনার এই সময়ে একদিকে দেনাদারের চাপ অন্যদিকে পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্থসংকটে কষ্টে দিনাতিপাত করছে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিরা। বিদেশ থেকে টাকা আসা কমে যাওয়ায় কোনো কোনো প্রবাসী পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে।
মোহাম্মদ নেছার উদ্দিন পাটওয়ারী সুমন (২৭)। সৌদি প্রবাসী এই যুবক এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ। আর এই টাকার সবটুকুই ছিল স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও, ব্যক্তিবগ, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া। তিন বছর বিদেশে কাটালেও ঋণের বোঝা কমছে না। এখনো প্রায় ৬ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।
নেছার উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার টামটা উত্তর ইউনিয়নের বলশিদ গ্রামে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিন মাসের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসে নেছার উদ্দিন। গত ৪ এপ্রিল তার সৌদি যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য আগেই যাবার প্লেনের টিকেট কেটে রেখেছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর সৌদি যাওয়া হয়নি এই যুবকের।
নেছার উদ্দিন জানায়, বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা ধার-দেনা করে সৌদিআরবে গত ৩ বছর আগে পাড়ি জমায়। দরিদ্র পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সৌদিআরবের জেদ্দায় যাওয়ার প্রথম এক বছর অলস সময় কাটাতে হয়। ফ্রি ভিসায় যাওয়ার কারণে কোনো কাজকর্ম হাতে ছিল না।
পরবর্তী দ্বিতীয় বছরে স্থানীয় একটি দোকানে ইলেকট্রিশিয়ান (বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি) হিসেবে কাজের সুযোগ মিলে। প্রথম অবস্থায় মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় হতো। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসার ৬ মাস আগে ৫০ হাজার টাকা করে পেত। এতে কিছুটা ঋণ পরিশোধ করা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সেই ঋণের বোঝা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে এই যুবক।
নেছার জানায়, ৫ ভাই ও ৩ বোন তারা। সংসারে তার স্ত্রী ও ১ সন্তান রয়েছে। তার বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী বেঁচে নেই। তিনি বলেন, চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। ঋণের টাকার জন্য লোকজন চাপ দিচ্ছে। আমি এখন কি অবস্থায় আছি, তা বোঝাতে পারবো না।
পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে। করোনার কারণে আমার বিদেশ যাওয়াও হলো না। অথচ আমি আসার সময় যাবার প্লেনের টিকেট কেটে রেখেছিলাম। হাতে টাকা-পয়সাও নেই।
মোহাম্মদ বাহালুল বকাউল (২২)। ওমান প্রবাসী এই যুবক গত মার্চ মাসে দেশে আসলেও করোনা ভাইরাসের কারণে বিদেশ যেতে পারেনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশে ফেরত আসা ঋণের ভারে জর্জরিত এই যুবকের উপর ভর করেছে নানা দুশ্চিন্তা।
পরিবারের অস্বচ্ছলতা ও দারিদ্র্যতা দূরীকরণে এক বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমায়। স্বপ্ন ছিল-অবস্থার পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক সংকট দূর করবে। কিন্তু মহামারী করোনা তার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। বিদেশে পাড়ি জমাতে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ধার-দেনা করলেও, সেই টাকার বোঝা কিভাবে পরিশোধ করবে, তা বুঝে উঠে পারছে না।
বাহালুল বকাউলের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নের উত্তর ডুমুরিয়া এলাকায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে পরিবারের সবার বড় সে। বাবা আইয়ুব আলী বকাউল বেঁচে নেই।
বাহালুল বকাউল জানায়, ওমানে সে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতো। প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করতো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার ব্যয় মিটাতে গিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।
বিদেশে এক বছর অবস্থানকালে যা’ই উপার্জন করেছে, তা নিজের চিকিৎসার কাজে ব্যয় হয়েছে। পরিবারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিদেশ যেতে যেই পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে, সেই পরিমাণ আয় করা ও ধার-দেনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
বাহালুল জানায়, করোনা ভাইরাসের এই সময়ে সে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে আরও ৫০/৬০ হাজার টাকা ধার-দেনা করেছে। সামনে কিভাবে চলবে, কি কাজ করবে; কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
মো. ইমান বকাউল (২৯)। তিনি গত ৮ বছর যাবত দুবাই প্রবাসী। তিন মাসের ছুটিতে গত জানুয়ারি মাসে দেশে আসেন। তিন মাস পার হয়ে গেলেও করোনার কারণে আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। তার বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকায়।
বেকার সময় কাটছে এই যুবকের। দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান করা এই যুবককে করোনার প্রভাবে ঋণগ্রস্ত। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার-দেনা করেছেন। পরিবারের অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।
ইমান বকাউল জানায়, করোনার কারণে বিদেশে যেতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় বেকার অবস্থায় রয়েছেন। বিদেশে অবস্থানকালে মাসে ২০ হাজার টাকায় আয় করার সুবাদে কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়িতে টিনের বসতঘর তুলেন। দুবাইয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ করতো ইমান বকাউল। বর্তমানে করোনায় আর বিদেশে যেতে পারবে কি-না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে এই যুবক।
চাঁদপুর জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসের তথ্য মতে, গত মার্চ পর্যন্ত চাঁদপুর জেলা থেকে ৩ লাখ ৫২ হাজার লোক বিভিন্ন দেশে গেছে। সর্বশেষ চলতি বছর এই জেলা থেকে ৭ হাজার ৫শ’ জন লোক বিদেশ যায়।
চাঁদপুর জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসের সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে সম্প্রতি নিবন্ধন কমে গেছে। চলতি জুন মাসে এই জেলার মাত্র ১৫/১৬ জন লোক নিবন্ধন করেছেন। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের এই সময়টিতে কত লোক বিদেশ থেকে এসেছেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে গত ১ মার্চ থেকে বিদেশ থেকে প্রত্যাগত হয়েছেন ৫ হাজার ১শ’ ৪৬ জন। যাদের মধ্যে ৪ হাজার ১শ’ ৮ জনকে ঠিকানা ও অবস্থান চিহ্নিত করে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।(প্রবাহ)
বার্তা কক্ষ,২৬ জুন ২০২০