দেশে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ মে.টন : গেলো বছর ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে.টন

চাঁদপুরসহ সারাদেশে চলতি অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ মে.টন হওযার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে.টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে বলে মৎস্য বিভাগ সুত্রে জানানো হয়েছে। প্রতি বছর দেশের নদ-নদী থেকে জাটকা ধরা নিষিদ্ধকরণ এবং অক্টোবরে মা-মাছ রক্ষার কর্মসুচি ছিল।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারাদেশে এবার ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৭৫ হাজার মে.টন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । এবার হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে টন এবং চলতি বছর ৬ লাখ টন উৎপাদন ।

গবেষকদের মতে, ২০১৬-১৭ সাল থেকেই মৎস্য বিভাগের গবেষকগণ অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পরীক্ষা করে দেখছে যে প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন মিঠা পানি থেকে বেরিয়ে ইলিশ যখন সাগরে প্রবেশ করে তখন তারা ওখানে ৬৫ দিন বড় হতে থাকে। যার ফলে অনাকাংক্ষিত জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা হলেও আমরা এ ব্যাপারে আশাবাদী যে আমাদের ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধিপাবে ।

সরকারের মৎস্যবিভাগ ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে আজ ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ,পরিবহন,ক্রয়-বিক্রয়,মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে । ইলিশ উৎপাদন বাড়াতেই সরকারের এ উদ্যোগ গ্রহণ ।

প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধের সময় নির্ধারণ এবং মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২২ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,‘ চলতি বছর ১ হাজার ৩৫২ মে.টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে যার ফলে আয় হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ১৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন,‘বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ ইলিশ। এটি আমাদের জাতীয় মাছ। এ মাছ দেশের মানুষের খাদ্য ও নিরাপদ আমিষের যোগানের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন,কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১১.২২ ভাগ আসে শুধু ইলিশ থেকে যা একক প্রজাতি হিসেবে সর্বোচ্চা। জিডিপি-তে এর অবদান শতকরা ১ ভাগ।

বাংলাদেশের ইলিশ ইতোমধ্যে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮০ % বেশি আহরিত হয় এদেশের নদ-নদী,মোহনা ও সাগর থেকে।’

তিনি আরো বলেন,‘বর্তমান সরকার সমন্বিতভাবে নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় ইলিশের উৎপাদন আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থ-বছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২.৯৮ লাখ মে. টন। বর্তমান সরকারের নেয়া ব্যবস্থাপনায় তা ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে.টনে উন্নীত হয়েছে। বিগত ১২ বছরে দেশে ইলিশ আহরণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এ সময়ে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ৯০ %।’

সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় বরফ কল বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। গত বছরের মতো এবারও অবৈধ জাল উৎপাদনস্থলে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অবৈধ পথে ইলিশ পাচার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইলিশ সম্পৃক্ত জেলা-উপজেলায় নদীতে ড্রেজিং বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ইলিশের নিরাপদ প্রজননের মাধ্যমে ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে যা যা করা দরকার তা করতে হবে।’

অতীতে এত ইলিশ উৎপাদন হয়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন,‘ সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে গ্রাম-গঞ্জে এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারছে। ইলিশ রপ্তানিও করা যাচ্ছে।’

দেশের ৬টি অভয়াশ্রম সুরক্ষিত রাখতে অব্যাহত প্রচেষ্ট থাকলে আমরা অবশ্যই আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে। গত বছর অক্টোবর মাসে ৫১.৭৬ % মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে । ইলিশ উৎপাদনে এটা একটা নতুনমাত্রা । তাই দেশের অভয়াশ্রমগুলোতে উৎপাদন বাড়াতে দেশের সব প্রজননগুলোতে ২২ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম ঘোষণা করেছে সরকার। সব ধরণের মাছ আহরণ,বেচা কেনা ,মজুদ ও পরিবহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইলিশের এ প্রজনন সময়ে সরকারের মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে জেলেদের ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

উৎপাদন বাড়াতে সরকার চলতি বছর জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালে দেশের ২০ জেলার ৯৭ টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭শ জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে ফেব্রুয়ারি-মে পর্যন্ত ৪ মাসের জন্য ৫৯ হাজার ১৪১ মে.টন ভিজিএফ প্রদান করা হয়েছে। ২০২২ সালে সামুদ্রিক জলসীমায় ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধকালে সমুদ্র উপকূলীয় ৩ লাখ ১১ হাজার ৬২ টি জেলে পরিবারকে ২৬ হাজার ৮৩ মে.টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায় ।

দেশের প্রজননের সময় জাটকা ধরা নিষিদ্ধকরণ ও ইলিশ ধরা বন্ধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার এ সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দেশের খ্যাতিমান ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান জানিয়েছেন।

দেশে গত অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে.টন। যেখানে ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার মে.টন । চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ লাখ মে.টনে হওয়ার কথা রয়েছে ।

সম্প্রতি ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণ বন্ধ করে মাছের অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করে ও সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছ্ । এবার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি,জাটকা সংরক্ষণ,মা ইলিশ আহরোণ বন্ধ রাখায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীসমুহ আরো ইলিশ সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অভয়াশ্রমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমনকি ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও অঞ্চলটি ৮২ কি.মি.অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার যোগ্য ।

মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় অভয়াশ্রমের জেলাগুলো হলো বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও লক্ষ্মীপুর। এ ছাড়াও ৩১ জেলার ১৫৫ উপজেলার অংশবিশেষ এ নিষেধাজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নিরাপদ প্রজনন শেষে ইলিশ যাতে সাগরে ফিরে যেতে পারে সে জন্যই এ নিষেধাজ্ঞা। প্রায় সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা এর আওতা আছে।’

মৎস্য অধিদপ্তরের সুত্রে জানা যায়,চাঁদপুর থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চরআলেকজান্ডার ১ শ কি.মি, ভোলার চরপিয়াল থেকে মেঘনার শাহবাজপুর পর্যন্ত ৯০ কি.মি, পটুয়াখালীর চররুস্তম ও তেঁতুলিয়া নদীর ১শ কি.মি, শরীয়তপুরে নরিয়া ও চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় মেঘনার ২০ কি.মি ও বরিশালের হিজলা মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনা,কালাবদর ও গজারিয়া নদীর ৮২ কি.মি এলাকা এ নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। চলতি বছর ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭ জেলেকে ২৫ কেজি করে ১৩ হাজার ৮৭২ দশমিক ১৮ টন খাদ্য দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,নিবন্ধিত প্রকৃত জেলেদের চাল পাওয়া নিশ্চিত করতে ৩৭ জেলা প্রশাসককে বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. এসএম যোবায়দুল কবির স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ছয়টি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকরা মঞ্জুরিকৃত ভিজিএফের চাল ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ইলিশ আহরণে বিরত থাকা নিবন্ধিত ও প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মধ্যে ১ নভেম্বরের মধ্যে বিতরণ সম্পন্ন ও নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হিসাব সংরক্ষণ করবেন এবং ৬ নভেম্বরের মধ্যে মাস্টাররোল পাঠাবেন।

জেলা প্রশাসকরা বরাদ্দপ্রাপ্তির পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুকূলে উপবরাদ্দ প্রদান করবেন এবং সংশ্লিষ্ট জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অবহিত রাখবেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপবরাদ্দ প্রাপ্তির পাঁচ কর্মদিবসের মধ্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুকূলে ডিও প্রদান এবং বিতরণ সূচি তৈরি করা সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেছেন,‘এ চাল যাতে নির্দিষ্ট নিবন্ধিত জেলেরা পান তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারের অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন। যদি কোনো অনিয়ম ধরা পড়ে বা অনিয়মের খবর পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলের জন্য বরাদ্দ করা চাল যাতে জেলেরাই পান তা নিশ্চিত করতে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।’

বাংলাদেশে সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,২০০১-০২ সালে বাংলাদেশে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টন, ২০২০-২১ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে। যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। মাছের প্রজনন যেখানে এক শতাংশেও কম ছিল, সেটা এবার বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণা ও স্থাপনের নির্মিত্তে অনুমোদিত। এক একটি অভয়াশ্রম হচেছ এক একটি রূপালী ইলিশ উৎপাদনের কারখান। প্রয়োজন শুধু ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন। তাহলেই বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের ও সহনশীল উৎপাদনের গতিধারা বজায় থাকবে এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে।

আবদুল গনি, চাঁদপুর টাইমস
৯ অক্টোবর ২০২২

Share