মোঃ ফয়সাল আহমেদ (৪১)। একটি প্রথম সারির ঔষধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি। তার কর্মস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ। সেখানকার পাঠানতলী এলাকার একটি বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। রাজধানীর সীমান্তবর্তী ওই শহরে করোনার তীব্র সংক্রমণ দেখা দিলে ফয়সাল তার শ্বশুর বাড়ি চাঁদপুর সদরের রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা গ্রামে চলে আসেন। জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্টসহ করোনার উপসর্গ থাকলেও তথ্য গোপন রেখে শ্বশুর বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এমনকি নিজ বাড়ি মতলব উত্তরের কাসিমপুরেও যাননি তিনি।
১ এপ্রিল থেকে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর ১১ এপ্রিল বিকেলে তিনি মারা যান। তখনো পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য বিভাগকে কিছুই জানানো হয়নি। এলাকাবাসীর মাধ্যমে খবর পেয়ে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সন্দেহভাজন মৃত হিসেবে তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করে। তার নমুনা সংগ্রহ করে করোনা টেস্টের জন্য পাঠানো হয় আইইডিসিআর পরীক্ষা কেন্দ্রে। করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মারা গেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।
তখন মৃতের পরিবারের উদ্ধৃতি দিয়ে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেন, মৃত ফয়সাল করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না, ছিল না লক্ষ্মণও, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। করোনার উপসর্গে মারা গেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করায় ওই পরিবারের পক্ষে সেই জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনাও করেছিলেন।
১৪ এপ্রিল রিপোর্ট আসে মৃত ফয়সাল করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। চাঁদপুরে এটি’ই প্রথম করোনায় মৃত শনাক্তের ঘটনা। তখনও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকার কথা স্বাস্থ্য বিভাগকে জানায়নি।
তবে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের দায়িত্ববোধ থেকে ওই পরিবারের সবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠায়। রিপোর্ট আসলো ফয়সালের শ্বশুর ও শালিকা করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে তার শ্বশুর এখন সুস্থ এবং করোনা মুক্ত। তবে শালিকা এখনো করোনায় আক্রান্ত। অবশ্য ফয়সাল বা তার শ্বশুর-শালিকার মাধ্যমে পরিবারের বাইরে অন্য কেউ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা জানার সুযোগও সীমিত।
অথচ শুরুতে ফয়সালের অসুস্থতার বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানালে এবং নমুনা পরীক্ষা করালে তিনি আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জেনে সতর্ক থাকতে পারতেন, কিছু চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগও পেতেন। নিদেনপক্ষে একসাথে বসবাস করা শ্বশুর পরিবারের অন্যরা করোনা থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ হতো।
এরপর জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে (করোনার প্রধানতম উপসর্গ) আক্রান্ত শারমিন আক্তার (১৪) নামের এক কিশোরীকে ২২ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকজন। অবস্থা গুরুতর বিবেচনায় রাতেই তাকে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
পরদিন ২৩ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শারমিন মারা যায়। তার ক্ষেত্রেও আগে থেকে অসুস্থতা তথা করোনার উপসর্গে ভোগার বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো হয়নি। একেবারে শেষ সময়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। মৃত্যুর পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা হয়। ২৫ এপ্রিল সকালে রিপোর্ট আসে ওই কিশোরী করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।
চাঁদপুরে এটি দ্বিতীয় করোনায় মৃত শনাক্তের ঘটনা। এখানেও মারা যাওয়ার আগে মৃত বা তার স্বজনরা জানতে পারেননি মেয়েটি করোনায় আক্রান্ত ছিল। জানার চেষ্টাও করেননি হয়তো। শারমিনের বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ১০নং দক্ষিণ গোবিন্দপুর ইউনিয়নের পশ্চিম লাড়ুয়া গ্রামে।
চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তৃতীয় শনাক্তকৃত ব্যক্তির নাম আবুল বাশার ওরফে বাসু মিয়া (৭০)। ফরিদগঞ্জের ৯নং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের পূর্ব ধানুয়া গ্রামের এই বৃদ্ধ করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান ২৭ এপ্রিল ভোর রাতে। মৃত্যুর আগে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও পাতলাপায়খানায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এতগুলো উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য বিভাগকে তা জানানো হয়নি। করোনা টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়নি।
তবে তার মৃত্যুর পর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল চৌধুরীর আগ্রহে স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করে। নমুনা সংগ্রহের ৬ দিন পর ৩ মে রিপোর্ট আসে বাসু মিয়া করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। রিপোর্ট পাওয়ার পর তার পরিবারের কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে করোনা টেস্টের জন্য ঢাকা পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসলে তাদের খবর জানা যাবে।
চাঁদপুরে করোনায় সর্বশেষ মারা গেছেন ফাতেমা বেগম (৪০)। গত শুক্রবার (১ মে) রাত ৮টার দিকে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি সদর হাসপাতালে আসেন। তখনি তার অবস্থা গুরুতর দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি দেন। ভর্তির দেড় ঘন্টার মাথায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি মারা যান।
মৃত্যুর পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা হয়। তার মৃত্যু পরবর্তী সংগৃহীত নমুনা টেস্টের রিপোর্ট করোনা পজেটিভ এসেছে। মঙ্গলবার (৫ মে) গভীর রাতে চাঁদপুরের স্বাস্থ্য বিভাগে ওই রিপোর্ট আসে। তিনিও প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিতে যাননি।
ফাতেমা বেগম চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোড এলাকার মুন্সী বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার স্বামীর নাম মৃত জাহাঙ্গীর। তাদের বাড়ি হাজীগঞ্জের পূর্ব রাজারগাঁও গ্রামে।
এ নিয়ে চাঁদপুর জেলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৪জন। এই ৪জনের সবার’ই মারা যাওয়ার পর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২জন সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তির কয়েক ঘন্টা পর এবং ২জন বাড়িতে মারা গেছেন।
এদিকে চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের বাঘড়া বাজার এলাকার বাসিন্দা খোরশেদ আলম গত ২৩ এপ্রিল ঢাকার তার কর্মস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে নমুনা দিয়ে বাসায় যাওয়ার পর তিনি মারা যান। তার মৃতদেহ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। ২৮ এপ্রিল পরিবারের লোকজন ঢাকা থেকে জানতে পারেন খোরশেদ আলমের করোনা রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। ওইদিন বিকেলে বিষয়টি জানার পরে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ গিয়ে ওই বাড়ি লকডাউন করে দিয়েছে।
এরপর মৃতের পরিবারের ৩জনের করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করেছেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। ২৩ এপ্রিল রিপোর্ট আসে মৃত খোরশেদ আলমের এক ছেলেও করোনায় আক্রান্ত। সেই ছেলে বাবার লাশ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। করোনা টেস্টের রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত সে দিব্যি এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন তার মাধ্যমে আর কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগ সন্দেহজনকভাবে খোরশেদ আলমের ছেলের নমুনা সংগ্রহ না করলে সেও করোনা আক্রান্তের বিষয়টি অজানা থেকে যেত এবং করোনার সংক্রমণ ঘটিয়ে চলতো।
চাঁদপুরে এভাবেই করোনার উপসর্গ থাকা লোকজনের তথ্য গোপনের কারণে করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। একই সাথে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকিও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়া কারো কারো শরীরে উপসর্গ উপলব্ধিও হচ্ছে না। যেমন- হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার শরীরে করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। সচেতনতা ও সতর্কতার অংশ হিসেবে তিনি নমুনা দিয়েছিলেন। টেস্টে রিপোর্ট আসে তিনি করোনায় আক্রান্ত।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, তার পজেটিভ রিপোর্ট যেদিন আসে তার আগে হাজীগঞ্জ উপজেলায় আর কারো করোনা শনাক্ত হয়নি। এখানে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, আক্রান্ত অথচ শনাক্ত হননি এমন কারোর মাধ্যমে তিনি আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনেরও। হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো এমন সচেতন লোকের সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। এমন উপসর্গহীন করোনায় আক্রান্ত লোক আরো বেশি ঝুঁকির কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনার উপসর্গ থাকা লোকদের তথ্য গোপনের বিষয়টি এখন স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ও কর্মীদের জন্য প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। একে তো এতে সন্দেহভাজন লোকজন করোনা টেস্টের বাইরে থেকে যাচ্ছেন আবার এদের কারো কারো অবস্থা গুরুতর হলে তারা চিকিৎসকের কাছে যেয়েও সব উপসর্গ বলছেন না।
এতে করে ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ঝুঁকি বাড়ছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের। আবার ডাক্তার সন্দেহ করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা নিলে উপসর্গের কথা না বলায় ল্যাব টেকনোলজিস্টরাও আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন। এমনিভাবে মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন ল্যাব টেকনোলজিস্ট ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অবশ্য বর্তমানে তারা সুস্থ ও করোনা মুক্ত।
চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত যতজন জীবিত থাকা করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই সব উপসর্গ চিকিৎসককে বলেননি। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সন্দেহ করে নমুনা সংগ্রহের পর তাদের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। এমন বাস্তবতায় ঝুঁকি এড়াতে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসা অধিকাংশের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে এখন। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম উপসর্গ থাকা কিংবা সামান্যতম সন্দেহ হলেই তার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
চাঁদপুর শহরের সর্বশেষ একটি ঘটনা তথ্য গোপনের বিষয়টি নিয়ে নতুন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। একাধিক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, শহরের নতুনবাজার এলাকার এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখানে তার করোনা টেস্ট হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু রিপোর্ট সুনিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। চাঁদপুরে নমুনা না দেওয়ায় জেলার স্বাস্থ্য বিভাগেও তার বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। ভদ্রলোকও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না।
জানা গেছে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে (করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র) তাকে রেফার করা হলেও তিনি নতুনবাজারস্থ নিজ বাসায় চলে এসেছেন। তার সাথে সাক্ষাৎ করা তার এক ভাগ্নে ও ভাগ্নের আরেক বন্ধুর করোনা সনাক্ত হয়েছে। এতে করে তিনি আক্রান্ত হওয়ার স্থানীয় জনশ্রুতি আরো বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। এলাকাবাসীর ধারণা, ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত জেনেও তা গোপন রেখেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ২ যুবক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
এছাড়া করোনার হটস্পট হিসেবে খ্যাত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রচুর লোক চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এরা নিজের অথবা স্বজনদের বাসা-বাড়িতে অবস্থান করছেন। এদের অনেকেই পরিপূর্ণভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন না মেনে দোকানপাট, বাজার, আত্মীয়স্বজনদের বাসা-বাড়িতে বেড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চাঁদপুরে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তদের অনেকেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরত কিংবা তাদের সংস্পর্শে আসা। জেলার প্রথম ও দ্বিতীয় আক্রান্ত যুবক নারায়ণগঞ্জ ফেরত। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরত আরো অনেকে পরবর্তীতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। প্রথম মৃতও নারায়ণগঞ্জ ফেরত। এছাড়া ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
তবে চাঁদপুরে আক্রান্ত ও মৃতের মধ্যে অনেকের কোনো হিস্ট্রি পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে ফয়সাল ছাড়া মৃত অন্য তিনজনের দেশ-বিদেশের অন্য স্থান থেকে আসা কিংবা তেমন লোকেদের সংস্পর্শে থাকার কোনো হিস্ট্রি নেই। ভয়টা এখানেই বেশি। তবে কী সর্বত্র করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে! উপসর্গে আক্রান্ত অনেকেই কী তথ্য গোপন করছেন- এমন প্রশ্ন এখন দিন দিন জোরালো হচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত হয়ে একাধিক লোক খুব সহজে জীবিত/মৃত অবস্থায় চাঁদপুরে চলে আসার নিশ্চিত তথ্য থাকায় অজানা এমন আরো অনেকের আগমন ঘটেছে কিনা- চিন্তায় রাখতে হচ্ছে এমন ধারণাকেও।
চাঁদপুর জেলায় ৪ মে পর্যন্ত সর্বাধিক করোনা রোগী (জেলার ২২জনের মধ্যে ১০জন) শনাক্ত হওয়া চাঁদপুর সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন এ বিষয়ে বলেন, করোনার রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের কাছে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে উপসর্গ থাকা রোগী/লোকজন তথ্য গোপন করছে।
খুব বেশি সমস্যা না হলে কেউ তার মধ্যে বিদ্যমান উপসর্গ/লক্ষ্মণ সম্পর্কে মুখ খুলছে না বা চিকিৎসকের কাছে আসছে না। আর চিকিৎসকের কাছে আসলেও সব উপসর্গ/সমস্যা না বলে কিছু বিষয় বলে বাড়িতে চিকিৎসা নিতে চাচ্ছেন। তথ্য গোপনের কারণে রোগী সনাক্তকরণ ও আক্রান্তদের চিকিৎসা/কোয়ারেন্টাইন/আইসোলেশনে রাখার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া তথ্য গোপনের কারণে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি।
চাঁদপুর জেলায় করোনা সনাক্তকরণ, চিকিৎসা, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা কেন্দ্র চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতাল। এই হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ও করোনা বিষয়ক ফোকালপার্সন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, আমাদের কাছে করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা আসছেন তাদের অধিকাংশই সব উপসর্গ বলতে চান না।
আর অধিকাংশের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকার ব্যাপারে চরম অনাগ্রহ। তাই তারা তথ্য গোপন করে। তারা চায়, সামান্য ঔষধ নিয়ে বাসায় চলে যেতে। যদিও আমরা রোগীর অবস্থা বুঝে নিজ নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা/কোয়ারেন্টাইনে থাকার সুযোগ দেই। এমনকি আক্রান্ত অনেককেও আমরা অবস্থা তুলনামূলক ভালো বিবেচনায় নিজ নিজ বাসায় থাকার অনুমতি দেই। বাসায় থেকেও আক্রান্ত অনেকে ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তারপরও নমুনা দিতে অনেকেই অনাগ্রহী। এরাই তথ্য গোপন করছে।
আবার ভিন্ন চিত্রও আছে। দু’-চারজন সচেতন মানুষ নিজে থেকে উপসর্গের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেন ও নমুনা দিয়ে যান। এমন কেউ কেউ উপসর্গ না থাকলেও সচেতনতা ও সতর্কতার অংশ হিসেবে নমুনা প্রদান করেন করোনা টেস্টের জন্য। তথ্য গোপন করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে খুব সহায়ক হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।
চাঁদপুরের একজন প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ও বেলভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. হারুন-অর-রশিদ (সাগর) বলেন, করোনার উপসর্গ/লক্ষ্মণ গোপন রাখা একটি ভয়ংকর বিষয়। আমিও এমন দু’-চারজন লোকের সন্ধান পেয়েছি। আমি তাদেরকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য সরকারি হাসপাতালে রেফার করেছি। এ ধরনের লোক সাধারণত প্রাইভেট হাসপাতাল ও প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের কাছে যেতে বেশি আগ্রহী হয়। তাই এমন লোকদের কারণে আমরাও (প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার) ঝুঁকিতে আছি। পাশাপাশি জ্ঞাত উপসর্গের বাইরে উপসর্গহীন আক্রান্ত ব্যক্তি আরো বেশি ঝুঁকির কারণ।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষকর্তা সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় অনেকের শরীরে করোনার উপসর্গ/লক্ষ্মণ থাকা সত্ত্বেও তারা তা প্রকাশ করছেন না। এটা খুবই বিপদজনক ও ভয়ানক বিষয়। এতে সমাজে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব যারা করেন তারা একাধারে নিজের, পরিবারের আপজন, আত্মীয়স্বজন এমনকি পুরো এলাকার মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারেন।
সিভিল সার্জন অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কারো শরীরে করোনার উপসর্গ/লক্ষ্মণ দেখা দেওয়া মাত্র সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা চিকিৎসকের সাথে যেন যোগাযোগ করেন। সবার বুঝা উচিৎ, করোনায় আক্রান্ত মানেই মৃত্যু নয়। তাছাড়া কেউ আক্রান্ত হলে এবং তা জানা গেলে পরিবারের অন্য সকল সদস্যকে সহজেই সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তি কোয়ারেন্টাইনে থেকে। আক্রান্ত ব্যক্তি চাইলে আমরা তাকে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ারও সুযোগ দিচ্ছি। আক্রান্তদের নাম-পরিচয়ও আমরা প্রকাশ করছি না।
আশার খবর হচ্ছে- চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত যেই ১০জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন তাদের ৫জন’ই নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। সুতরাং তথ্য গোপন কমে আসলে করোনার ঝুঁকিও কমে আসবে।
সিভিল সার্জন আরো জানান, আক্রান্ত সন্দেহে কেউ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা/চিকিৎসক/হাসপাতাল কিংবা হটলাইনে ফোন করলে সন্দেহভাজন মনে হলে আমরা ওই ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির সুবিধাকে আমরা অগ্রাধিকার দেই। তিনি যেখানে চান সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ব্যক্তির বাসা-বাড়ি যেয়েও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আবার ব্যক্তি চাইলে হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যেয়েও নমুনা দিতে পারেন।
এছাড়া উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে অথবা উপসর্গ থাকা লোকের সন্ধান পেলে আমরা নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করি। তাছাড়া কেউ আক্রান্ত হলে (জীবিত/মৃত) তার পরিবারের সদস্য ও নিকট অতীতে সংস্পর্শে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর বাইরে কেউ উপসর্গ/লক্ষ্মণ থাকা সত্ত্বেও তথ্য গোপন করলে তাকে করোনা টেস্টের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতেই আমরা চাঁদপুরে বিদেশ প্রত্যাগত লোকদের তালিকা করে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করেছি। স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে এসব লোকের অবস্থান ও চলাফেরা মনিটরিং করার ব্যবস্থা করেছি। যাতে কারো মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার আওতায় আনা যায়।
পরবর্তীতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকদেরও একইভাবে তালিকা করে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করেছি। মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা এখনো কাজ করছে। কারো কোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার খবর পেলে কিংবা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। লকডাউন করা হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সন্দেহভাজন মৃতদের বাড়ি।
অন্যদিকে আক্রান্ত রোগী, তাদের স্বজন, উপসর্গ থাকা লোকজন, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূলত সামাজিক লোকলজ্জার ভয়, পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশী থেকে একাকী হয়ে পড়া এবং জীবিত/মৃত উভয় ক্ষেত্রে ঘৃণিত/অবহেলিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই অধিকাংশ মানুষ তথ্য গোপন করছে। কেউ কেউ নিছক অসচেতনতা, অবহেলা, উদাসীনতা ও খেয়ালের বশে করোনার উপসর্গের তথ্য গোপন করছেন।
যদি উপসর্গ গোপনকারীর সংখ্যা বেশি হয় অথবা অল্প হলেও তারা যদি বেশি মাত্রায় সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করেন তবে যে কোনো সময় চাঁদপুরে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। যদিও চাঁদপুরের স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান করোনা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান আশপাশের অন্যান্য জেলার তুলনায় কিছুটা স্বস্তিদায়ক।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন : সিনিয়র সাংবাদিক রহিম বাদশা
সহ-সভাপতি : চাঁদপুর প্রেসক্লাব