চাঁদপুরে উচ্ছেদ আতঙ্কে শত শত পরিবার, দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে

আওয়ামী সরকারের ১৭ বছরের লুটপাট যেন আজো থামছে না। শুধু হাত বদলে চলমান রয়েছে সেই লুটপাটের ধারা। এমনটাই মনে করছেন এখন লক্ষীপুর ৬নং ওয়ার্ডের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা। চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড লক্ষীপুর গ্রামে সরকার গড়ে তুলেছিলো বাস্তুহারা মানুষের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র। সেই আশ্রয় কেন্দ্রে ঘর রয়েছে সাড়ে সাত শতাধিক পরিবারের। বিগত ১০ বছর আগে এসব ঘর বরাদ্দ দিয়েছিলো বাস্তুহারা আশ্রহীন মানুষের জন্য। যদিও সেই সময় আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তৎকালীন সময়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে বিনামূল্যের ঘর বরাদ্দ দেওয়া এবং সেই বরাদ্দ নিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগকারীরা জানান, ‘তৎকালীন সময়ে ঐসব ঘর বরাদ্দ দিতে গিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ঘর প্রতি নিয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। টাকা পরিশোধ করলেই পেতেন বরাদ্দের ঘর। এছাড়া টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দের পাশাপাশি নিজের পছন্দমতো নেতাকর্মীদের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ ছিলো তাদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেক বিত্তবান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঘর বরাদ্দ বাগিয়ে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের লোকজন এসব অবৈধভাবে ঘরের বরাদ্দ নিতেন বলে আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা জানান। এরপর টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন বাস্তুহারা মানুষের কাছে। মূলতঃ ঐসব অসহায় মানুষগুলোই শেষ পর্যন্ত ঘর কিনে নিয়ে বসবাসের সুযোগ নিয়েছিলেন এই আশ্রয়ন প্রকল্পে।

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলে ঐ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো দখলে নেয় লক্ষীপুর এলাকার কিছু দুস্কৃতিকারী মানুষ। যারা সৈর সরকারের পতনের সুযোগে নিজেদের দলীয় প্রভাব খাঁটিয়ে বসবাসকারী অনেক মানুষকে ঘর থেকে বের করে দেয় বলে অভিযোগ করেন। এর মধ্যে যারা নতুন করে তাদেরকে টাকা দিয়ে ঘর বরাদ্দ নিতে পেরেছেন তারা এখন বসবাস করছেন বলে অভিযোগ করেন বসবাসকারীরা। আর যারা টাকা দিতে পারেননি তারা বসবাসের ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। সম্প্রতি ভুক্তভোগী অনেকে এমন অভিযোগ করেছেন সাংবাদিকদের কাছে।

এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী অধিকাংশই ঐ চক্রটিকে ১০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয়েছে। যারা টাকা পরিশোধ করেনি তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকে। কিছুদিন পর ঐসব তালাবদ্ধ ঘরে নতুন বসবাসকারীকে দেখে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা ঘর কিনে নিয়েছি। আপনার নামে ঘর বরাদ্দ নেই কিন্তু আপনি কিভাবে কিনে নিলেন’ জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা নুরু ভুইয়ার কাছ থেকে এসব ঘর কিনে নিয়েছি।’ জানা যায় আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় এখন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরু ভুইয়ার নিজের লোকজনকে ব্যবহার করে এসব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তিনিই এখন আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর নতুন করে বরাদ্দ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা।

আর এসব দখল বিক্রি ও হয়রানীর সাথে জড়িত রয়েছেন ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি মোক্তার দর্জি, ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য শাহ আলম দর্জি, আশ্রয়ন প্রকল্পের সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা দুদু গাজী, ৬নং ওয়ার্ড যুবদলের সেক্রেটারী মানিক, ইউনিয়ন বিএনপির নেতা ভুট্টু, ৬নং ওয়ার্ড যুব দলের সভাপতি মামুন, ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সাধারন সম্পাদক হানু খা সহ আরো অনেকে। তারা সবাই নুরু ভুইয়ার হয়ে কাজ করেন বলে জানা যায়।তবে জানা যায় নুরু ভুইয় পতিত সৈরাচার সরকারের সময় ততকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি সেলিম খানের খুব ঘনিষ্টজন ছিলেন। আওয়ামী লীগের সময় নুরু ভুইয়া তার সাথে থেকে সেলিম খানের বিভিন্ন অপকর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন। অথচ উপর দিয়ে তিনি বলতেন যে তিনি নির্যাতিত। এমনটাই মনে করছেন ইউনিয়ন বিএনপির তৃণমুল নেতাকর্মীরা। উপরের ছবিতে সেলিম খানের সাথে আওয়ামী লীগের মিটিং এ থাকতে দেখা যায় নুরু ভুইয়াকে। অথচ এই নুরু ভুইয়াকেই এখন পেছন থেকে সেল্টার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চাঁদপুর জেলা বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতার বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে বসবাসকারী সালমা নামের একজন বিধবা নারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের শালা কাশেম গাজী ও মেম্বার শাহ আলম মাঝির মাধ্যমে ৬০ টাকা করে দিয়ে তিনটি ঘর বরাদ্দ পাই। আমার মায়ের নামে এবং আমার নামে ভুমি অফিসের সেই কাগজপত্র করা হয়েছে। আমাদের কাছে সেই কাগজপত্র এখনো আছে। একটি ঘর নুরু ভুইয়ার লোকজন জোর করে তারা নিয়ে গেছে। বাকি দুটি ঘর ছেড়ে দিতে তারা চাপ দিচ্ছে। আর না হয় টাকা দিতে হবে বলে তারা আমাকে হুমকি ধমকি দিচ্ছে।’‘তাদেরকে টাকা না দেওয়ার কথা বললে তারা আমার উপর হামলা চালায়। তাদের আক্রমনে আমি আহত হই। আমি একজন বিধবা নারী। আমার মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। তারা আমাকে কু প্রস্তাব দেয়। তাদের কু প্রস্তাবে রাজি না হলে এখানে থাকা যাবে না বলে জানান তারা। বর্তমানে আমি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। এব্যাপারে নুরু ভুইয়ার কাছে গেলে নুরু ভুইয়া আমাকে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। আপনি টাকা না দিলে এখানে থাকতে পারবেন না। আমি তারপরও তাকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারপরও আমাকে দলে দলে এসে ঘরে থাকতে দেয় না।’

এব্যাপারে জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক সাহেবের কাছে গেলে আমাকে তার বাসায় ঢুকতে দেয়নি। তাই আর কিছু বলতে পারিনি। আমার কোন সহায় সম্পদ নেই। এখান থেকে আমাকে নামিয়ে দিলে আমি কোথায় যামু।’

এছাড়া আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারী, আলী আক্কাছ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছ থেকে ঘর নিয়েছি। আমাদের কোন বাসস্থান না থাকার কারণে তখন আমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছি। তখনো টাকা দিয়ে আমরা ঘর নিয়েছি এখন আবার আমরা টাকা দেওয়া ছাড়া ঘরে থাকতে পারছি না।’ এগুলো এখন কে দেখবে কারো জানা নাই। আমরা যাদেরকে দেখছি তারা সবাই নাকি নেতা। আগে ছিলো এক দল এখন আরেক দল আইছে।’রহিমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আসলে আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কোন জাগাজমি নাই। আমরা সরকারের দেওয়া এই আশ্রয়ের ঘরে থাকি। এখন জনে জনে আমাদের কাছে টাকার জন্য আসে। এছাড়া আমরা কেউ এখন তাদের কাছে নিরাপদ না। আমাদেরকে এই ঘরে থাকতে হলে নাকি তাদের কথা মতো সব করতে হবে। এখন আমরা কোথায় যাবো?’

অনুসন্ধানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো অনেক বাসিন্দা সাংবাদিকদের জানান, ‘ঐসব ব্যক্তিরা বর্তমানে নিজেকে বিএনপির নেতাকর্মী হিসেবে নিজেদের দাবী করেন। অথচ তাদের অধিকাংশই আওয়ামীগ সরকারের সময় তাদেরকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী দিসেবে সেলিম খানের সাথে চলাফেরা করতে দেখেছি। কিন্তু বর্তমানে তারা বিএনপি ও যুব দলের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাদেরকে ব্যবহার করে ইউনিয়ন বিএনপির কিছু নেতা তাদের সার্থ হাসিলে লিপ্ত হয়েছে।

তবে জানা যায়, ইউনিয়ন বিএনপির এসব নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। জেলা বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতারাই এসব অপকর্মের পেছনে রয়েছে বলে মনেকরছেন নেতাকর্মীরা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আগামীর রাষ্ট্র নায়ক তারেক রহমানের নির্দেশকে উপেক্ষা করে তারা কেন এসব দখল ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত তা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের তৃণমূল নেতাকর্মীদের বুঝে আসছে না বলে জানান অনেকে। নেতাকর্মীরা বলেন, দলকে এভাবে বিতর্কিত যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আমাগামীর রাষ্ট্র নায়ক তারেক রহমান অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। যারা এসব করে বেড়াচ্ছে তারা অবশ্যই দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে। আমরা তারেক রহমানের সৈনিক হিসেবে বলতে চাই, এসব দুস্কৃতিকারীদের অপকর্মের কোন দায় বিএনপি নেবে না।’

এদিকে আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা বলেন, আমরা বর্তমানে ঐসব দুস্কৃতিকারীদের কারণে অনেক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। আমরা এ ব্যাপারে প্রশাসন সহযোগীতা কামনা করছি।

স্টাফ করেসপন্ডেট, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

Share