করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫টিতেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। ১০ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিনেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে এমন ৩১টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলা ঢাকা বিভাগে। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, মৃত্যুও এই বিভাগে বেশি। সারা দেশে এক সপ্তাহে মারা যাওয়া ২৪৯ জনের মধ্যে ১৭৮ জনই ঢাকা বিভাগের।
অথচ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বিভাগে উচ্চ সংক্রমণ থাকা ১১ জেলার ছয়টিতেই আইসিইউ নেই। জেলাগুলো হলো: টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নরসিংদী, রাজবাড়ী ও মুন্সিগঞ্জ। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিভাগে মারা গেছেন ৩১ জন। এই বিভাগে উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইসিইউ নেই।
উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা খুলনা বিভাগের নড়াইল ও যশোর, রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ ও নাটোর এবং রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায় আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে রাজশাহীতে ১৫ জন, খুলনায় ১১ জন ও রংপুর বিভাগে ৩ জন মারা গেছেন।
জটিল রোগী পাঠাতে হয় অন্য জেলায়
নরসিংদী জেলায় এখন চিকিৎসাধীন করোনা রোগী ৩৭৬ জন। এ রোগীদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে নির্ধারিত সাধারণ শয্যা আছে ১১০টি। গত মঙ্গলবার রোগী ভর্তি ছিলেন ২৭ জন। করোনা রোগীদের জন্য জেলার কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই। নরসিংদী জেলা হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে ২টি।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এ এন এম মিজানুর রহমান বলেন, জেলায় প্রশিক্ষিত লোকবলসহ প্রয়োজনীয় আইসিইউ থাকলে করোনা রোগীদের আরও উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব হতো। রোগীরা একেবারে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তখন কিছু করার থাকে না।
দুটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অধিকাংশ রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন। শ্বাসকষ্টের মতো জটিলতা দেখা দেওয়ার পরে হাসপাতালে আনা হয়। আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা না থাকায় দ্রুত অন্য জেলায় স্থানান্তর করা হচ্ছে।
কিছুদিন ধরে প্রায় সব জেলাতেই নতুন রোগী বাড়ছে। এর মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে রোগী বৃদ্ধির হার বেশি। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার সব কটিতেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। অথচ বরিশাল বিভাগের শুধু বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এই বিভাগে গত এক সপ্তাহে মারা গেছেন ৬ জন।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জাফর আলী দেওয়ান বলেন, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে সংকটাপন্ন রোগীদের বরিশাল শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে করোনার জটিল রোগীদের আইসিইউর চেয়েও উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন বেশি হয়। এ জন্য জেলা হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা থাকা প্রয়োজন। সংক্রমণ ঝুঁকির ৩১ জেলার মধ্যে অন্তত ৪টি জেলায় কোনো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নেই। অধিকাংশ জেলায় ১ থেকে ৫টি করে নাজাল ক্যানুলা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে ৭১৫টি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় গতকাল হাসপাতালগুলোর সুযোগ-সুবিধা ও শয্যা বৃদ্ধির বিষয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ বাড়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও দুই হাজার হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা পাঠানো হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগী রাখার জায়গা নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বেড না হয় বাড়ালাম, কিন্তু রোগী আরও বাড়লে তাতেও লাভ হবে না। প্রতিদিন ৫ হাজার লোক আক্রান্ত হলে এবং সবাই হাসপাতালে এলে সারা দেশকে হাসপাতালে রূপান্তর করলেও রোগীর জায়গা দিতে পারব না। তিনি ঢাকায় জোরাজুরি না করে কাছের জেলাগুলোতে গিয়ে সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ঢাকায় আইসিইউর জন্য হাহাকার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০টি হাসপাতালের ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে গতকাল ১০৩টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১টি এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল এবং মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ২টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল।
মিরপুরের বাসিন্দা রুবেল হাসানের ৮০ বছর বয়সী শ্বশুর করোনায় আক্রান্ত। মিরপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ওই হাসপাতালে আইসিইউ ছিল না। গতকাল ঢাকার বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করেও একটি আইসিইউ শয্যা জোগাড় করতে পারেননি রুবেল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল থেকে পাগলের মতো একটা আইসিইউ খুঁজেছি। কিন্তু কোনো হাসপাতালের আইসিইউ ফাঁকা নেই। দুপুরের পরে মালিবাগের একটি ক্লিনিকের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।’
ঢাকার দুটি সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের চিকিৎসক বলেন, আইসিইউ ফাঁকা নেই, কিন্তু আইসিইউর চাহিদা অনেক। অধিকাংশ সময়ই ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আইইসিইউর অপেক্ষায় থাকছেন। রোগীর স্বজনেরা রীতিমতো কান্নাকাটি করছেন একটি আইসিইউর জন্য। চিকিৎসকেরা নিরুপায় হয়ে গেছেন। অন্য হাসপাতালে যে পাঠাবে, সেখানেও একই অবস্থা।
ঢাকায় আইসিইউর পাশাপাশি সাধারণ শয্যাতেও রোগীর চাপ বেড়েছে। ঢাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৫১১টি। এগুলোর মধ্যে ২ হাজার ২৪৬টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিলেন। ফাঁকা ছিল ২৬৫টি শয্যা।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। গতকাল এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ৪২১ জন, অর্থাৎ ধারণক্ষমতার ১৪৬ জন বেশি। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেও ধারণক্ষমতার চেয়ে ১১ জন করোনা রোগী বেশি ভর্তি ছিলেন।
১০ মাসেও বাস্তবায়িত হয়নি নির্দেশনা
গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে বলেন তিনি। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। এর আগে গত বছরের ২৭ এপ্রিল দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন বলেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো যন্ত্রপাতি, শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আইসিইউ পরিচালনা করতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো লোকবলের অভাব রয়েছে।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেশন দরকার হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরেও জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ করা যায়নি। ১০ মাসে আইসিইউর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। করোনা রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারেই মনোযোগ দেয়নি। – প্রথম আলো
বার্তা কক্ষ,১ এপ্রিল ২০২১