ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশে আগামি ১ আগস্ট, শনিবার পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার ঈদুল আজহা ও কোরবানি পালন করতে হবে। তারপরও মুসলমানরা ঈদুল আজহা ও কোরবানি পালন করবেন।
আল্লাহতায়ালার আদেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করতে উদ্যত হন। তার সেই ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহার দিন পশু কোরবানি করে থাকেন। আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা পালিত হয়।
কোরবানিকে ভিত্তি করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন ও সন্তুষ্টির অপার সুযোগ মেলে। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন, যতটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কোরবানির বিধান হজরত আদম (আ.)-এর পর থেকে আল্লাহ প্রদত্ত সব শরিয়তেই কার্যকর ছিল।
প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল এক অপরিহার্য অংশ। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করেন। এটা মানুষের চিরন্তন স্বভাব, এ স্বভাবের স্বীকৃতি প্রদান করে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদের দান করেছেন।’ সুরা হজ: ৩৪
কোরবানি হলো চিত্তশুদ্ধি এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা, প্রতি মুহূর্তে যার করুণা প্রত্যাশী মানুষ। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তার উদ্দেশেই নিবেদিত এবং কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক। কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কি না সেটা পরীক্ষা করা হয়। কোরবানি আমাদের সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
আল্লাহর কাছে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদের এখন আর সন্তান কোরবানি দেওয়ার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারি। ইমানের এ কঠিন পরীক্ষায় যারা বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন, তারাই হন তত বড় খোদাপ্রেমিক সফল মানুষ।
কোরবানির পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রাহ্য হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, যে অকুণ্ঠ ইমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের প্রতি ছুরি চালিয়েছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ে কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ইমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে।
কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ইমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে ওঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তাদের এই কোরবানির উৎসব গোশত খাওয়ার পর্বেই পর্যবসিত হবে। আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কোরবানিদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কোরবানির পশুর গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তার কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।’ সুরা হজ: ৩৭
কোরবানি কেবল পশু কোরবানি নয়। নিজের ভেতরের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহঙ্কার ত্যাগের কোরবানি। নিজের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সবকিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি।
এ কোরবানি পশু জবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব বিসর্জন এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এ কোরবানি মানুষের আকাক্সক্ষা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মূলত কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার।
আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি সার্থক হয়েছে, কোরবানির ঈদ সার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠান থেকে যাবে চিরকাল। কোরবানির একনিষ্ঠ নিয়ত ও যে পরিমাণ গোশত দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়, সেটুকুই কেবল পরকালে আমাদের পাথেয়।
বস্তুত কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে লুক্কায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। ভেতরের থাকা অনাচারের বীজগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন ও আল্লাহভীরু মুসলমান হতে হবে। আমাদের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ হোক, আসন্ন ঈদুল আজহায় মহান রবের কাছে এ প্রার্থনা রইল।
লেখক : শাহীন হাসনাত , মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক । ২৪ জুলাই ২০২০
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur