ইসলাম

ইসলামে হিজড়াদের অধিকার ও বিধিবিধান

মহান আল্লাহর সৃষ্টির সেরা হল মানুষ। মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন নারী ও পুরুষ রূপে। হিজড়া হল মনোদৈহিক বৈকল্য বা শরীরবৃত্তীয় ও মনোজাগতিক বিকাশের অপূর্ণতা। এটি হরমোনঘটিত একটি সমস্যা।

শরীরের যে হরমোনের কারণে একজন মানুষ পুরুষ বা নারী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, সেই হরমোন পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকাই এর প্রধান কারণ। সুতরাং অত্যাধুনিক হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে এবং ক্ষেত্রবিশেষ শল্যচিকিৎসার (Surgery) মাধ্যমে এর পুরোপুরি স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের সুচিন্তিত মতামত, সুশীল সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সরকারের সিদ্ধান্ত, প্রশাসনের সদিচ্ছা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতা।

ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী হিজড়ারা সাধারণ মানুষের মতই তাদের পূর্ণ অধিকার লাভ করবে। লেখাপড়া, শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উত্তরাধিকার, সম্পদের মালিকানা; ধর্ম-কর্ম, সামাজিক ও উন্নয় কাজের সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রেই তাদের ন্যায্য অধিকার ইসলাম স্বীকার করেছে।

কিন্তু আমাদের সমাজে পর্যাপ্ত ইসলামী জ্ঞান না থাকায় এবং নানান কুসংস্কার ও সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক দৈন্যতার কারণে হিজড়ারা বঞ্চিত ও অবহেলিত; ক্ষেত্রবিশেষ নিপীড়ন ও নির্যাতনের স্বীকার। তাই ইসলামী বিধান মতে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।

মানব সৃষ্টির এ রহস্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে : হে মানব মণ্ডলী! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক সত্তা (আদম) হতে; আর তা হতে তৈরি করলেন তার জোড়া (হাওয়া) এবং এতদ্বয় হতে বিস্তৃত করলেন বহু পুরুষ ও নারী। (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১)।

পবিত্র তিনি, যিনি সৃজন করেছেন সকল কিছু জোড়ায় জোড়ায় যা ভূমিতে উৎপন্ন হয় এবং তোমাদের নিজেদের মাঝেও আর তাতেও যা তোমরা জান না। (সূরা-৩৬ ইয়াসীন, আয়াত: ৩৬)।

আর যিনি বানিয়েছেন সবকিছু জোড়ায় জোড়ায়। (সূরা-৪৩ যুখরুফ, আয়াত: ১২)। আর নিশ্চয় তিনি সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী। (সূরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ৪৫)।

হে মানবজাতি! নিশ্চয় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। আর আমি বানিয়েছি তোমাদের জোড়ায় জোড়ায় (পুরুষ ও নারী)। (সূরা-৭৮ নাবা, আয়াত: ৮)।
নিশ্চয় আমি ব্যর্থ করি না কোন আমলকারীর কর্ম, হোক সে পুরুষ বা নারী। (সূরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৫)।
নির্দেশ দিচ্ছেন আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে, পুত্রের জন্য দুই কন্যার সমান অংশ। (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১১)।

আর যদি হয় তারা বোন ও ভাই, তবে পুরুষের জন্য দুই নারীর সমান অংশ। (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৭৬)।

যে সৎকর্ম করবে সে পুরুষ বা নারী যদি সে বিশ্বাসী হয়, তবে আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব। (সূরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৯৭)।

আর যে সৎকর্ম করবে সে পুরুষ বা নারী যদি সে বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সূরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৪০)। তোমাদের জন্য কি পুত্র আর তার জন্য কন্যা। (সূরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ২১)। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী। (সূরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ৪৫)।

অতপর তিনি করলেন তা হতে জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী। (সূরা-৭৫ কিয়ামাহ, আয়াত: ৩৯)। আর যা তিনি সৃষ্টি করেছেন পুরুষ ও নারী। (সূরা-৯২ লাইল, আয়াত: ৩)।

আসমান ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহর জন্যই, তিনি যা ইচ্ছা সৃজন করেন; যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন।

অথবা পুরুষ ও নারীতে দম্পতি তৈরি করেন আর যাকে ইচ্ছা নিঃসন্তান রাখেন; নিশ্চয় তিনি মহাজ্ঞানী ক্ষমতাবান। (সূরা-৪২ শুরা, আয়াত: ৪৯-৫০)।

পশু পাখি ও প্রাণিকুল সৃষ্টির বিষয়েও কোরআন মজিদে অনুরূপ বলা হয়েছে: ‘অষ্ট জোড়া (সৃষ্টি করলেন), ভেড়ার দুটি (একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী), ছাগলের দুটি (একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী), বলুন- তিনি কি পুরুষ দুটি হারাম করেছেন নাকি স্ত্রী দুটি? নাকি স্ত্রী দুটির গর্ভে যে বাচ্চা রয়েছে তা? তোমরা জ্ঞানত আমাকে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। এবং উটের দুটি (একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী), গরুর দুটি (একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী); বল, তিনি কি পুরুষ দুটি হারাম করেছেন, নাকি স্ত্রী দুটি? নাকি স্ত্রী দুটির গর্ভে যে বাচ্চা রয়েছে তা!

নাকি আল্লাহ যখন এরকম নির্দেশ দিয়ে ছিলেন তখন তোমরা উপস্থিত ছিলে? অতএব যে মানুষকে বিপথগামী করার জন্য না জেনে আল্লাহর নামে মিথ্যা বানিয়ে বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে আছে? আল্লাহ জালিমদের হিদায়াত করেন না। (সূরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৪৩-১৪৪)।

উল্লেখ্য, আট সংখ্যাটি স্বকীয়মান সংখ্যার বৃহত্তম জোড় সংখ্যা।

কোরআনুল কারীমের উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা স্পষ্টতই বোঝা যায় আল্লাহ মানব সমাজকে নারী ও পুরুষ দুইভাগে বিভক্ত করেছেন।

হাদিস শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা এদের হিজড়া বলো না; এরা নারী বা পুরুষ।

যে কারণে ফকীহগণ হিজড়াকে দুইভাগে বিভাজিত করেছেন, যথা- নারী হিজড়া ও পুরুষ হিজড়া। অর্থাৎ পুরুষ হিজড়া হলো অপূর্ণ পুরুষ (নারীও নয় এবং নারী পুরুষের মাঝামাঝিও নয়); আর নারী হিজড়া হলো অপূর্ণ নারী (পুরুষও নয় এবং পুরুষ ও নারীর মাঝামাঝিও নয়)।

এ কারণে নারী হিজড়ারা পুরুষ সমাজে যাওয়া নিষেধ এবং পুরুষ হিজড়ারা নারী মহলে প্রবেশ করা নিষেধ রয়েছে।

সম্পদের উত্তরাধিকারের বণ্টন ও মালিকানা এবং সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রেও হিজড়াকে নারী বা পুরুষ কোন এক শ্রেণির আওতায় আনতে বলা হয়েছে।

ঈমান, ইসলাম, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এমনকি বিয়েশাদিসহ সব ইসলামী বিধিবিধান তাদের ওপর (নারী ও পুরুষ হিসেবেই) বর্তাবে।

অনুরূপভাবে হালাল হারাম, ন্যায়-অন্যায়, হুদুদ ও কিছাছ এবং জান্নাত-জাহান্নামও তাদের জন্য নারী বা পুরুষ হিসেবেই প্রযোজ্য হবে। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো হিজড়া আলাদা কোনো সত্তা নয়; এরা নারী বা পুরুষ।(লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্কলার্স ফোরাম বাংলাদেশ, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইন্সটিটিউট অব সূফীজম )

বার্তাকক্ষ,১০ নভেম্বর,২০২০;

Share