আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টার বাকী,তারপর বাংলাদেশে লাগবে সুরের ও রঙের মাতন। চারদিকে দেখা যাবে লাল, নীল, হলুদ রঙ। মাথার উপর উঠে নাচবে নানা রঙের পশু-পাখি। গ্লানি ও জ্বরা মুছে যাওয়ার কামনায় হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা তরুণ আর বাসন্তি রঙের শাড়ি পরা তরুণীদের পদচারণায় মুখরিত হবে জনপথ। বাতাস ভরে উঠবে ইলিশের গন্ধে। মেলায়, মাঠে ময়দানে চলবে পানতা পানের হিড়িক। বছর ঘুরে এলো বৈশাখ; এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
বৈশাখ এলেই বারবার উঠে আসে একটা শব্দ- ‘হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য’। এই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে আজ অজপাড়াগায়েও বৈশাখী উৎসব পালন করা হয়; বৈশাখী মেলা বসে সর্বত্র। আগে পুরাতন কাপড়েই বৈশাখ পালন করা যেত এখন নতুন বৈশাখী জামা লাগে। পহেলা বৈশাখ যেন বাঙালিদের ঈদের দিন। তবে এই ‘হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যে’র বয়স কিন্তু মোটেও হাজার বছর না। খুব বেশি দিন আগে না, বৈশাখী উৎসব সীমাবদ্ধ ছিলো রমনা বটমূলে, তারপর দেশের নামকরা কিছু স্থানে এখন সারাদেশে। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে বৈশাখ কখনই উৎসবের মাস ছিলো না, বৈশাখ ছিলো কর্মব্যস্ততার মাস।
উৎসব ধর্ম পালনের অংশ :
উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষ্যগুলো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে তাতে রয়েছে উৎসব পালনকারী জাতির ধমনীতে প্রবাহিত ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া। উদাহরণস্বরূপ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড় দিন তাদের বিশ্বাসমতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হতো ২৫শে মার্চ এবং তা পালনের উপলক্ষ্য ছিল, ঐ দিন খ্রিস্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরীর নিকট এ মর্মে ঐশী বাণী প্রেরিত হয় যে, মেরী ঈশ্বরের পুত্র জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এ দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হত। ইহুদীদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদীদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘সাবাত’ হিসেবে পালিত হয়।
এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসবের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তা-ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন। ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী: ৯৫২; মুসলিম: ৮৯২] বিখ্যাত মুসলিম প-িত ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ সম্পর্কে বলেন: “উৎসব-অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহপাক কুরআনে বলেন: ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৮) ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান [সময় ও স্থান] নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ (সূরা আল-হাজ্জ্ব, ২২:৬৭)
অতএব, অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেই। তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের সাথে একমত পোষণ করা। আর এসবের একাংশের সাথে একমত পোষণ করার অর্থ কুফরের শাখা বিশেষের সাথে একমত হওয়া। উৎসব-অনুষ্ঠানাদি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উৎসব দ্বারা ধর্মগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। নিঃসন্দেহে তাদের সাথে এসব অনুষ্ঠান পালনে যোগ দেয়া একজন মুসলমানকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর বাহ্যিকভাবে এগুলোতে অংশ নেয়া নিঃসন্দেহে পাপ।
উৎসব অনুষ্ঠান যে প্রতিটি জাতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, এর প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে। আর এটা আমাদের ঈদ।’ এছাড়া আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূল্লাল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এ দিনগুলোর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদের উত্তম কিছু দিন দিয়েছেন: কুরবানীর ঈদ ও রোযার ঈদ ”। (সূনান আবু দাউদ) এ হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।
নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কে ইসলামের চেতনা : ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দাদা তার পিতাকে পারস্যের নওরোযের দিন (নববর্ষের দিন) আলী (রা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন। (হাদিয়াটি ছিল নওরোয উপলক্ষ্যে। ফলে) আলী (রা.) বললেন, “নওরোযুনা কুল্লা ইয়াওম” মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। (আখবারু আবি হানিফা, সয়মারী) অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব-নিকাশ করবে এবং নব উদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলীর (র.) এ ফতোয়া দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, নববর্ষ উপলক্ষ্যে পরস্পরে উপহার বা প্রেজেন্টশন আদান-প্রদান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় নাজায়িয। নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পূজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান ইসলামে নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখ-, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তি যোগ্য হয়ে উঠবে। তাই একজন মুসলমানের কাছে বছরের প্রথম দিনের কোন বিশেষ কোন গুরুত্ব ও তাৎপর্য নেই। এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই।
আর সেক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের কি-ই বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?
কেউ যদি এ ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোন সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হল, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ এই উপলক্ষ দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হল। আর শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের ওপর কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেবেন।
সূর্যকে স্বাগত জানানো ও বৈশাখকে সম্বোধন করে স্বাগত জানানো: নববর্ষ উদযাপনের আর এক কর্মসূচি থাকে বছরের প্রথম প্রহরে প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানো ও রবি ঠাকুর রচিত বৈশাখ গান গাওয়া। এ ধরনের কর্মকা- মূলত সূর্য-পূজারী ও প্রকৃতি-পূজারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র। যা আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে পুনরায় শোভনীয় হয়ে উঠেছে। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে এসেছে।