শাহজাদী জেনি:
উপরোল্লেখিত সূত্র স্মরণ রেখে ইসলামী আদর্শের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, যে সব বিষয়ের দরুন মানব প্রকৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ (অর্থাৎ সন্তান জন্মানো) থেকে বিরত থাকার কারণ দেখা দেয়, সে সব বিষয়ের মূলেই ইসলাম কুঠারাঘাত করে থাকে।
এ কথা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, মানুষের মানুষ হবার দরুণ জন্মনিরোধ করার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় নি। আর মানুষের জন্মগত প্রকৃতিও এ ধরনের কোনো প্রবণতা রাখে না, বরং একটা বিশেষ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা মানব সমাজের ওপর চেপে বসার ফলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়, যার ফলে মানুষ নিজের আরাম ও সুখ-সমৃদ্ধির খাতিরে নিজের বংশ বৃদ্ধি বন্ধ বা সীমিত করার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়।
এ ব্যাপার থেকে আপনি নিজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, ভিন্ন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা হয়ে যদি পূর্বোল্লেখিত জটিলতা ও অসুবিধাগুলো সৃষ্টির পথই বন্ধ করে দেয়, তাহলে মানুষের জন্য আল্লাহর সৃষ্টিতে রদবদল, স্রষ্টার নির্দেশিত সীমা লংঘন এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত পথ ধরে চলার কোন প্রয়োজনই দেখা দেবেনা।
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের মূলোৎপাটন করে দিয়েছে। এ ব্যবস্থা সুদকে হারাম ঘোষণা করে, একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ বন্ধ করে দেয়, জুয়া ও কালোবাজারী অবৈধ ঘোষণা করে সম্পদ পূঞ্জীভূত করতে নিষেধ এবং জাকাত ও মীরাসী আইন জারী করে থাকে। এর সব বিধান এসব কুপ্রথা দূর করে দেয়, যেগুলোর ফলে পাশ্চাত্য অর্থ ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি ছাড়া বাকী সকল মানুষের জন্য এক আযাব স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নারীকে উত্তরাধিকার দান করেছে, পুরুষের উপার্জনে তার অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে- নর ও নারীর কর্মক্ষেত্রকে প্রাকৃতিক সীমারেখার আওতাধীন রেখেছে, পুরুষ ও নারীর অবাধ মেলামেশাকে পর্দার আইন মারফত নিষিদ্ধ করেছে এবং এভাবে অর্থ ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থায় এ সব ত্রুটি দূর করে দিয়েছে যেগুলোর দরন নারী সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালনের স্বাভাবিক কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা মানুষকে সরল ও আল্লাহভীরুর ন্যায় জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ-ব্যবস্থা ব্যভিচার ও মাদ্যপানকে হারাম করে দেয়, বহুবিধ মনোরঞ্জনকারী বাহুল্য কার্যকলাপ ও বিলাসিতা থেকে ফিরিয়ে রাখে, যেন সম্পদের অসদ্ব্যব্যবহার হতে না পারে; পোশাক, বাড়ীঘর ও বসবাসের সরঞ্জামাদির ব্যাপারে অল্প তুষ্টির মনোভাব সৃষ্টি করার জন্যে তাকিদ করে এবং পাশ্চাত্য সমাজের যেসব অপব্যয় ও সীমাতিরিক্ত ভোগ-স্পৃহা জন্মনিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সে ধরনের মনোভাবের জন্মই হতে দেয় না।
এছাড়া ইসলাম পরস্পরের প্রতি সমবেদনা, শুভেচ্ছা, পারস্পরিক সহযোগিতা, প্রতিবেশী ও দরিদ্র অসহায়দের সাহায্যার্থে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আদেশ দান করে। এসব বিধিবিধান পৃথকভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে এবং সমষ্টিগতভাবে সমগ্র সমাজে এমন একটি নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যার ফলে জন্মনিরোধ করার কোন কারণই দেখা দিতে পারে না।
সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে এই যে, ইসলাম আল্লাহভীতির শিক্ষাদান করেছে-আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা শিখিয়েছে এবং মানুষের মন-মগজে এ সত্য তথ্যটি দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করেছে যে, সকল জীবের প্রকৃত রেজেকদাতা হচ্ছেন আল্লাহ। এর ফলে মানুষের মনে নিছক নিজের উপায় উপাদান ও নিজের যাবতীয় চেষ্টা যত্নের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করার মত বস্তুবাদী মনোভাব জন্ম নিতেই পারে না।
সংক্ষেপে বলতে গেলে যেসব কারণে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও কৃষ্টিতে জন্মনিরোধ একটি আন্দোলনের রূপ ধারণ করতে পেরেছে, ইসলামের সমষ্টিগত আইন-কানুন নৈতিক ও আধ্যাত্নিক শিক্ষা সে সব কারণের মুলোৎপাটন করে দিয়েছে। যদি মানুষ চিন্তা ও কর্মের দিক থেকে খাঁটি মুসলমান হয়, তাহলে কখনো তার মনে জন্মনিরোধের আকাংখ্যা স্থান পেতে পারে না। আর তার জীবনে স্বাভাবিক পথ ছেড়ে দিয়ে বক্র পথে চলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না।
জন্মনিরোধ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ- এ যাবত যা আলোচনা হয়েছে তা ছিল নেতিবাচক (Negative)দিক। এখন ইতিবাচক (Positive) দিকও আলোচনা করা দরকার। জন্মনিরোধ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ কি?
কোরআন মাজীদের এক আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টি কাঠামোতে রদবদল করাকে শয়তানী কাজ বলে আখ্যাদান করা হয়েছে-
-“(শয়তান বললো) আমি এদের হুকুম দেবো আর এরা তদানুযায়ী সৃষ্টি কাঠামোতে রদবদল করবে।” আন-নিসা-১১৭
এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর সৃষ্টি কাঠামোতে রদবদল করার অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালা যে বস্তুকে যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অথবা তাকে এমনভাবে ব্যবহার করা, যাতে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।
এ মূলনীতির মাপকাঠিতে দেখা দরকার যে, নর ও নারীর সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য কি এবং জন্মনিরোধের দ্বারা উদ্দেশ্যের পরিবর্তন সাধন হয় কি না। এ প্রশ্নের উত্তর কোরআন থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। কোরআন নর ও নারীর দাম্পত্য সম্পর্কের ব্যাপারে দুটি উদ্দেশ্য পেশ করে।
একটি হচ্ছেঃ
-“তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের ফসলের জমির মত। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী জমিতে যাও এবং ভবিষ্যতের সংস্থান কর।” আল-বাকারাহ-২২৩
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছেঃ –“আর আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনগুলোর মধ্যে এও একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা তাদের নিকট শান্তি লাভ কর এবং তোমাদের মধ্যে যেন পারস্পরিক মহব্বত সৃষ্টি হয়।” আর-রূম-২১
প্রথম আয়াতে নারীদেরকে ‘ফসলের জমি’ আখ্যা দিয়ে একটি জৈনিক সত্য (Biological fact) পেশ করা হয়েছে। জীব বিজ্ঞান মুতাবিক নারীর মর্যাদা ফসলের জমির মতই, আর পুরুষের অবস্থা চাষীর মত। আর উভয়ের মিলনের সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বংশ রক্ষা। এ উদ্দেশ্যের কি দিয়ে মানুষ, জন্তু জানোয়ার ও গাছপালা সবাই সমান।
জনৈক ভদ্রলোক এ আয়াত থেকে জন্মনিরোধের সমর্থন হাসিল করার জন্য এক অভিনব ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। তিনি বলেন, জমির সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক শুধু ফসল উৎপাদনের জন্যে। যখন দেশে ফসলের প্রয়োজন থাকে তখন কৃষক জমিতে যাবে। আর যখন ফসলের কোন দরকার থাকবে না তখন জমিতে যাবার কোন অধিকার থাকবে না।
তাছাড়া যে পরিমাণ ফসল উৎপন্ন করা দরকার, চাষী সে পরিমাণ চাষ রবে, এর বেশী নয়। এ অদ্ভূত তাফসীর অনুসারে প্রথমত, বন্ধ্যা নর-নারীর মিলন হারাম হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, গর্ভ ধারনের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মিলন পরবর্তী সন্তান জন্মানোর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হবার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত হারাম হয়ে যায়। তৃতীযত, স্বামী-স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়।
যখন সরকার ঘোষণা করবে যে, আমাদের দেশে আর সন্তানের প্রয়োজন নেই তখন থেকে সকল স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে পৃথক থাকতে হবে, যতক্ষণ পুনরায় কোন সরকারী ঘোষণা সন্তান জন্মানোর প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ না করা হয়। আর পুনরায় ঘোষণা করা মাত্রই সকল স্বামী-স্ত্রী মিলিত হবে এবং এর ফলে কত সংখ্যক নারী গর্ভবতী হয়ে গেল সরকারকে তার রিপোর্ট সংগ্রহ করে সময মত লাল নিশান তুলে ধরতে হবে যেন পুনরায় স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
রবুবিয়াতের এ পরিকল্পনা এমন চিত্তাকর্ষক যে কম্যুনিস্টরাও এ যাবত এর সন্ধান পায় নি। আর মজার ব্যাপার এই যে, বিষয়টা কোরআন থেকেই বের করা হয়েছে। অথচ স্বামী-স্ত্রীর পাস্পরিক সম্পর্ককে কৃষক ও জমিনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, এ শব্দার্থ মুতাবিক অর্থ গ্রহণ করেও আজ পর্যন্ত কারো মগজে এ অর্থ প্রবেশ করে নি যে, জমিতে বীজ বপন করার পর কৃষকের জন্যে জমিতে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়।]
দ্বিতীয় আয়াতে নর-নারীর সম্পর্ক স্থাপনের আরও একটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির স্থায়িত্ব। স্বামী-স্ত্রীর মিলিত জীবন যাপনই তমদ্দুনের বুনিয়াদ। এ উদ্দেশ্যটা মানুষেরই জন্যে, আর মানুষের দৈহিক সৃষ্টির মধ্যেই এ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার যাবতীয উপাদান মওজুদ রাখা হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টি বা খালকুল্লাহর ব্যাখ্যা -এ বিশ্বের বিরাট কারখানা পরিচালনার জন্যে আল্লাহ তায়ালা এক সর্বব্যাপী শক্তিশালী ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে খাদ্য বিষয়ক আর অপরটি বংশ বিস্তার। খাদ্য বিষয়ক ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে এই যে, বর্তমানে যে সব সৃষ্টির অস্তিত্ব আছে তাদের এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবিত থেকে কারখানার কাজ পরিচালিত হরতে হবে।
এ জন্যে মহান প্রতিপালক প্রভু প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করছেন। দেহের অভ্যন্তরস্থ অংশগুলোতে খাদ্য হজম করা এবং সেগুলোকে দেহের অংশে পরিণত করার ক্ষমতা দিয়েছেন। উপরন্তু এ উদ্দেশ্যেই খাদ্যের প্রতি সৃষ্টির একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর এর ফলেই তাদের প্রত্যেক খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
এ ব্যবস্থার অভাবে প্রত্যেক দেহধারী (উদ্ভিদ, জন্তু অথবা মানুষ) ধ্বংস হয়ে যেতো এবং সৃষ্টি জীবের জীবন রক্ষার চাইতেও বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা বহাল রাখার গুরুত্ব বেশী। কেননা, ব্যক্তির জীবনকাল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং এ সীমাবদ্ধ আয়ু শেষ হবার আগেই বিশ্বের কারখানাকে সচল রাখার জন্যে তার স্থান দখলদারী তৈরী হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
এ দ্বিতীয় ও মহান উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্যেই স্রষ্টা সন্তানাদি জন্মের ব্যবস্থা করেছেন। সৃষ্টিতে পিতৃ ও মাতৃশক্তিতে বিভক্ত কর, উভয়ের দৈহিক কাঠামোতে পার্থক্য রাখা, উভয়ের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এবং দাম্পত্য জীবন কায়েম করার জন্যে উভয় পক্ষের মনে প্রবল আকঙ্খা দান ইত্যাদি ব্যবস্থা থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উভয়ে যুক্ত হয়ে তাদের জন্যে সতত আগ্রহশীল। এ না হলে পিতৃ ও মাতৃশক্তির পৃথক পৃথক সৃষ্টিরই কোন প্রয়োজন হতো না।
পুনরায় লক্ষণীয় যে, যে জীবের সন্তান অনেক বেশী সংখ্যক হয় তাদের মধ্যে স্রষ্টা সন্তান লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে খুব বেশী আগ্রহ ও স্নেহ-মমতা দান করেন নি। কারণ এ সষ্ট জীবেরা শুধু বিপুল সংখ্যক সন্তান জন্মের কারণেই বংশ টিকিয়ে রাখে।
কিন্তু সেব জীবের সন্তান কম হয় তাদের মনে স্রষ্টা এত সন্তান বাৎসল্য দান করেছেন যে, মাতা পিতা সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়। মানব সন্তান সকল সৃষ্ট জীবের তুলনায় দুর্বলতম হয়ে জন্মায় এবং তাকে দীর্ঘকাল মাতা পিতার তত্ত্বাবধানে জীবন যাপন করতে হয়।
পক্ষান্তরে পশুদের যৌনক্ষুধা ঋতুভিত্তিক অথবা প্রকৃতিগত চাহিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মানুষের যৌনক্ষুধা ঋতুভিত্তিক অথবা প্রকৃতিগত চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এজন্যেই মানব জাতির মধ্যে নর ও নারী পরস্পরের সঙ্গে স্থায়ীভাবে প্রেম-প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। এ দুটি বস্তুতই মানুষকে সামাজিক জীবে পরিণত করে। আর এখান থেকেই পারিবারিক জীবনের বুনিয়াদ রচিত হয়। পরিবার থেকে বংশ আর বংশ থেকে গোত্র হয়। আর এভাবেই সভ্যতার বিশাল প্রাসাদ নির্মিত হয়ে থাকে।
এবার মানুষের গঠন বৈচিত্র দেখা যাক। জীব-বিজ্ঞান অধ্যয়নে জানা যায় যে, মানুষের দেহ গঠনে ব্যক্তিগত স্বার্থের চাইতে বংশধরের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর মানুষের দেহে যত উপকরণ আছে, তার মধ্যে দেহের নিজস্ব কল্যাণের চাইতে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে অনেক বেশী।
মানব দেহের যৌন গ্রন্থিগুলো এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। এ গ্রন্থিগুলো একদিকে মানব দেহে ‘হরমোন’ (Hormon) বা জীবন-রস সঞ্চার করে এবং এর ফলে দেহে একদিকে সৌন্দর্য, সুষম্য, কমনীয়তা, সজীবতা, বুদ্ধিমত্তা, চলৎশক্তি, বলিষ্ঠতা ও কর্মশক্তি সৃষ্টি হয় এবং অপর দিকে এ যৌন গ্রন্থির প্রজনন শক্তি সৃষ্টি করে নর ও নারীকে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করে।
যে সময় মানুষ বংশ বৃদ্ধির কাজে নিযুক্ত থাকার যোগ্য থাকে, জীবনের সে অংশেই তার যৌবন, সৌন্দর্য ও কর্মশক্তি বিদ্যমান থাকে। আর যে সময়ে সে সন্তান জন্মানোর অযোগ্য হয়ে পড়ে, জীবনের সে অংশটাই দৌর্বল্য ও বার্ধক্যের জমানা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যস্থিত গোপন সম্পর্ক রক্ষায় দুর্বলতা আগমনের মানেই হলো মরণের অগ্রিম নোটিশ লাভ।
যদি মানুষের দেহ থেকে তার যৌন গ্রন্থিকে বাদ দেওয়া যায় তাহলে সে একদিকে যেমন মানব বংশ বৃদ্ধির কাজে নিযুক্ত থাকা রব্যাপারে অসমর্থ হয়ে পড়ে তেমনি অপর দিকেতার মানবীয় যোগ্যতা এবং কর্মশক্তি বহুলাংশে হ্রাস প্রাপ্ত হয়। কেননা যৌনগ্রন্থির অবর্তমানে দেহ ও মস্তিষ্কের শক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।
নারীদেহ সৃষ্টিতে বংশ বৃদ্ধির কাজটিকে পুরুষের দেহের তুলনায় অধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে। মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে মনে হয় যে, নারী দেহের যাবতীয় কল-কব্জা শুধু বংশ রক্ষার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। যে যখন যৌবন পদার্পণ করে তখনই তার মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয়।
এ ব্যবস্থা দ্বারা নারীদেহ প্রতি মাসেই গর্ভধারণের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে। শুক্রকীট গর্ভাধারে স্থান লাভ করে মাত্রই নারীদেহে এক বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়। ভাবী সন্তানের কল্যাণকারিতা তার সমগ্র দৈহিত ব্যবস্থার ওপর সুস্পষ্টভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তার জীবন রক্ষার জন্যে সর্বনিম্ন পরিমাণ দৈহিক শক্তি ছেড়ে দিয়ে অবশিষ্ট সমগ্র শক্তি সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
এ কারণেই নারীর স্বভাবেই স্নেহ, প্রীতি, ত্যাগ, কষ্ট ও সাহিষ্ণুতা (Fleruism) বদ্ধমূল হয়ে যায়। আর এজন্যই পিতৃত্বের সম্পর্কের তুলনায় মাতৃত্বের সম্পর্ক অধিকতর গভীর ও শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠে। সন্তান প্রসেবের পর নারী-দেহে দ্বিতীয় একটি বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং এর ফলে নারী সন্তানকে দুদ পান করানোর জন্যে তৈরী হয়।
এ সময় নারী-দেহের দুগ্ধগ্রন্থিগুলো তার খাদ্যের উত্তম অংশকে টেনে নিয়ে সন্তানের জন্যে দুধ সরবরাহ করার কাজে নিয়োজিত থাকে এবং এখানেও নারীকে ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্যে আর এক দফা ত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়।
সন্তানের জন্য দুধ সরবরাহ করার কাজ থেকে অবসর প্রাপ্তির সময় নিকটবর্তী হতে হতে নারী পুনরায় সন্তান ধারণের যোগ্য হয়ে ওঠে। এ কার্যরকণ-পরম্পা নারীর বংশ বৃদ্ধির যোগ্যতা থাকাকাল পর্যন্ত জারী থাকে। আর যখনই এ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়, তখনই সে মরণে পথে পা বাড়ায়।
বার্ধক্যের জমানা শুরু হতেই তার সৌন্দর্য ও সুষমা বিদায় নেয়, তার দৈহিক সজীবতা, কমনীয়তা ও আকর্ষণ খতমহয়ে যায় এবং দৈহিক যন্ত্রণা, মানসিক নিরাশক্তি ইত্যাদির এমন এক নয়া সূচনা হয়, যার সমাপ্তি ঘটে মরণের সঙ্গেই। এ আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, নারী ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্মে যতদিন জীবন ধারণ করে ততদিনই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ জমানা। আর জীবনের যে সময়টুকু নিজের জন্যে বেঁচে থাকে সে সময়টা তার জন্যে অত্যন্ত কষ্টকর।
এ বিষয়ে অ্যান্টন নিমিলোভ (Anton Nemilov) নামক জনৈক রুশীর লেখক একটি চমৎকার বই লিখেছেন। বইটির নাম Biological Tragedy of Woman (বায়োলজিক্যাল ট্রাজেডী অব অম্যান)।
১৯৩২ সালে লন্ডনে এর ইংরেজী তরজমা প্রকাশিত হয়। উক্ত পুস্তক অধ্যয়নে জানা যায় যে, নারী-জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানব বংশ রক্ষা। অন্যান্য গবেষক ও বিশেষজ্ঞগণও এ ধরনের মত প্রকাশ করেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্দ লেখক ডাক্তার এলিক্সিস ক্যারেল (Alixis Carrel) তাঁর Man the Unknown (অজ্ঞাত জীব মানুষ) গ্রন্থে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করতে গিয়ে বলেন, ‘নারীর সন্তান জন্ম দানের যে কর্তব্য এটা কি পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ তা আজও সঠিকভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। এ দায়িত্ব প্রতিপালনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুইনয়।”
যৌনবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ Dr. Oswald Schwarz (ডাঃ ওস্ওয়াল্ড সোরাজ) তাঁর The Psychology of Sex (যৌন বিজ্ঞান সম্পর্কিত মনস্তত্ব) বইলে লিখেন:
“যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য কি এবং এটি কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে সৃষ্ট? এ প্রেরণার সম্পর্ক যে বংশ বৃদ্ধির সঙ্গে, এটা সুস্পষ্ট। এ কথা উপলব্ধি করার ব্যাপারে জীব-বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করে থাকে।
এটা একটা প্রমাণিত জৈবিক বিধান যে, দেহের প্রতিটি অংগ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর এবং প্রকৃতি এদের প্রতি যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তা পূরণ করার জন্যে সতত উদগ্রীব। এ দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করলে জটিলতা ও বিপদ অনিবার্য। নারী দেহের বৃহত্তর অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যে সৃস্ট।
যদি কোন নারীকে তার দেহ ও মস্তিষ্কের এ দাবী পূরণ করা থেকে বিরত রাখা যায়, তা হলে সে দৈহিক ক্ষয় ও পরাজয়ের শিকারে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে সে মা হতে পারার মধ্যে এক নয়া সৌন্দর্য ও মানসিক স্বাস্থ্য লাভ করে, যা তার দৈহিক ক্ষয়ক্ষতির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে।” (১৭ পৃষ্ঠা)
এই লেখক আরো লিখেছেন: “আমাদের দেহের প্রতিটি অংগ কাজ করতে চায় এবং কোনো অংকে তার দায়িত্ব পালন থেকে নিরস্ত করলে এর পরিণতি স্বরূপ সমগ্র দৈহিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃংখলা দেয়। একটি নারীর শুধু এজন্যে সন্তানের প্রয়োজন হয় না যে, তার মাতৃত্ব এটা দ্ববী করে অথবা সে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনকে তৎপ্রতি আরোপিত একটি নৈতিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা করে, বরং এজন্যে তার সন্তানের প্রয়োজন যে, তার দৈহিক ব্যবস্থাপনা শুধু এ উদ্দেশ্যেই বিন্যস্ত হয়েছে। যদি তার দেহের এ সৃষ্টি- কার্যকে বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহালে সমগ্র দৈহিক ব্যবস্থাপনায় এক শূণ্যতা, বঞ্চনা ও পরাজয়ের অবস্থা সৃষ্টি হয়।”
এ আলোচনা থেকে এবং কোরআন মজিদে বর্ণিত তথ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য বংশ বৃদ্ধি এবং এ সংগে দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক জীবন যাপন করে মানবীয় তমুদ্দুনের ভিত্তি স্থাপন।
আল্লাহ তায়ালা নর ও নারীর মধ্যে যে আকর্ষণ ও উভয়ের দাম্পত্য জীবনে যে আনন্দ দান করেছেন তা শুধু এজন্যে, যেন মানুষ তার মজ্জাগত প্রেরণার চাপে আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে অগ্রসর হতে পারে।
এখন যে ব্যক্তি দাম্পত্য জীবনের সুখ ও আনন্দ উপভোগ করতে চায় এর পরিণতিকে মেনে নিতে প্রস্তুত হয় না, সে আল্লাহ তায়ালা তাকে যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মনব বংশ বৃদ্ধির জন্যে দান করেছেন সেগুলোকে সে আসল উদ্দেশ্য থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নিছক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে নিয়োগ করে।
এমন ব্যক্তির সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে- যে শুধু রসনা তৃপ্তির জন্যে ভাল ভাল খাদ্য চিবিয়ে গিলে ফেলার পরিবর্তে বাইরে নিক্ষেপ করে। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির মত এক ব্যক্তি দাম্পত্য জীবনের সুখ উপভোগ করে যদি মানব বংশ বৃদ্ধির পথ বন্ধ করে, তাহলে সে নিজরই ভবিষ্যৎ বংশকে হত্যা করে।
এটাকে আত্মবংশ হত্যা বলা খুবই সংগত। শুধু তাই নয়, বরং আমি বলবো যে, ঐ ব্যক্তি প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে। প্রকৃত যৌন মিলনে যে সুখানুভূতি রেখেছে তা শুধু বংশ-বৃদ্ধির প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার পুরষ্কার।
কিন্তু যে ব্যক্তি পুরামাত্রায় পুরষ্কার চায় অথচ কর্তব্য পালনে অস্বীকৃত স্থাপন করে সে কি ধোঁকাবাজ নয়?