রাজধানীর বাজারগুলো এখনও জাটকা ইলিশে সয়লাব। বাজারের মাছ বিক্রেতারা শত শত কেজি জাটকা ইলিশ হাঁকডাক দিয়েই বিক্রি করছেন। অথচ আজ ১ মার্চ (সোমবার) থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দু মাসের জন্য সারাদেশে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্ন— সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বাজারে বিপুল পরিমাণের জাটকা কোথা থেকে কিভাবে আসে। এছাড়াও নিষেধাজ্ঞা চলমান অবস্থায় বর্তমানে যে বিপুল পরিমাণের জাটকা আছে সেগুলোর কী হবে?
রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এসব জাটকা বিক্রেতারা যাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা না পড়েন সেজন্য ক্রেতাদের কাছে এগুলোকে জাটকা হিসেবে স্বীকার করছেন না। তারা এগুলো ‘সামুদ্রিক চাপিলা’ বলে বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি জাটকা বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা দরে। তবে সাইজ একটু বড় হলে তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। এগুলো এত ছোট যে প্রতি কেজিতে ১২ থেকে ১৪টি উঠছে। অথচ দেশের ৬ জেলার ৫টি ইলিশের অভয়াশ্রম এলাকায় জাটকা সংরক্ষণে সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। যা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি রোববার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও পটুয়াখালী জেলার ইলিশ অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট নদনদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
পাঁচটি অভয়াশ্রম এলাকা হলো চাঁদপুর জেলার ষাটনল হতে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলা জেলার মদনপুর বা চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা।
এছাড়াও শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা এবং বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর, গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাটকা সংরক্ষণে দেশের ৬টি জেলার ৫টি ইলিশ অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সবধরনের মাছ ধরার উপর এই নিষেধাজ্ঞা আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বলবত থাকবে।
প্রতিবছর মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস উল্লেখিত অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। এ সময় ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে ইলিশসহ সকল প্রকার মাছ ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই নিষেধাজ্ঞা যিনি অমান্য করবেন তিনি কমপক্ষে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকাকালীন অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট ৬টি জেলায় জাটকা আহরণে বিরত থাকা ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৮ জেলের জন্য মাসে ৪০ কেজি করে দুই মাসে ৮০ কেজি হারে মোট ১৯ হাজার ৫০২ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল ইতোমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। যা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের হাতে এসে পৌঁছাবে।
মন্ত্রী জানিয়েছেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষায় সরকার নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে, এটি তারই অংশ। আশা করছি এ বছরও দশে পাঁচ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদন হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোস্ট গার্ড, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির অতি লোভী জেলে ঘরে থাকার নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নামার চেষ্টা করছে। তাদের জালেই ধরা পড়ে শত শত টন জাটকা। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে যাচ্ছে এবং অবাধে বিক্রিও হচ্ছে।
চাঁদপুর বেষ্টিত ডাকাতিয়া নদীর মোহনা পেড়িয়ে মেঘনায় রাতের অন্ধকারে শত শত ছোট নৌকায় ইঞ্জিন লাগিয়ে ইলিশ শিকারে নামছেন জেলেরা। রাতে অভিযান পরিচালনা করা দিনের মতো নিরাপদ নয় বলে জেলা প্রশাসন, কোস্ট গার্ড বা মন্ত্রণালয়ের কোনও টিমই নদীতে থাকে না। এই কারণেই রাতটিকেই বেছে নেয় ওইসব অসাধু জেলেরা। তাদের জালেই ধরা পড়ছে শত শত মন জাটকা। যা দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের মাছ বিক্রেতা আলতাব মিয়া বলেন, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মিরপুর, ও কাওরান বাজারের মাছের আড়ত থেকে প্রতিদিন জাটকা কিনে নিচ্ছেন আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা তো কিনছেন, তাই আমরাও আনছি। লাভও তেমন খারাপ না। পুলিশের সামনেই তো এগুলো বিক্রি হচ্ছে। কেউ কোনওদিন কিছু বলেছে বলে তো শুনিনি।
তিনি জানান, মাছগুলো বাজারে না এলে আমরা কিনতাম না। নদীতে ধরা বন্ধ করতে পারলে বাজারে জাটকা বিক্রি এমনিতেই বন্ধ হবে। তিনি জানান, নদীতে জাটকা ধরা বন্ধ করতে না পারলে বাজারে হামলা দিয়ে ইলিশ রক্ষা করা যাবে না।
পিরোজপুরেরে পাড়েরহাটের জেলে লোকমান হোসেন জানিয়েছেন, জেলার সন্ধ্যা, বলেশ্বর, কালিগঙ্গা ও বেলুয়া নদীতে বাঁধা নেট দিয়ে জেলেরা জাটকাসহ প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত, যা দেশের জন্য হুমকি। শুধু এইসব নদীবেষ্টিত এলাকাই নয়, দেশের অধিকাংশ নদীতেই চলছে একই অবস্থা।
মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১০ ইঞ্চির ছোট সাইজের ইলিশ যাকে জাটকা নামেই চেনে সাধারণ মানুষ তা ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসময়ে জাটকা ধরা, বিক্রি, মজুত ও পরিবহন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
জেলেরা জানিয়েছেন, এ বছর বেশিরভাগ ইলিশ মাছ ডিম ছাড়তে পারেনি। বাংলাদেশের নদীতে এসে মা ইলিশ প্রতি বছর যে পরিমাণ ডিম ছাড়ে সেগুলোর রেণু ও ছোট জাটকা রক্ষা করা যায় তাহলে ইলিশের উৎপাদন আগামীতে ব্যাপকভাবে বাড়বে। কারণ বাঁধা জালে আটকা পড়া এক কেজি জাটকা মাছের বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা, যা এক বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার ইলিশে পরিণত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আরও জানিয়েছেন, করোনার মতো ভয়ঙ্কর অবস্থায়ও আমরা মৎস্যজীবীদের জন্য কাজ করছি। আগামীতে আরও বড় ধরনের পরিকল্পনা আমরা নেবো। ইতোপূর্বে যেসব জেলে মানবিক এই সহায়তা পাননি, এ বরাদ্দ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। মন্ত্রী বলেন, আমরা তালিকা বা তালিকার বাইরে, জেলে এবং জেলে সংশ্লিষ্টদের ভিজিএফ চাল বরাদ্দ দিচ্ছি।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,৩ মার্চ ২০২১