ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ % অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড- যা মানবদেহের কোলেস্টোরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তা ছাড়া ইলিশ মাছের আমিষের ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।
ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুযায়ী ৭-২৮ অক্টোবর ২০১৮ ( ২২ আশ্বিন থেকে ১৩ কার্তিক ১৪২৫) ২২ দিন দেশব্যাপি ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত,বাজারজাতকরণ,ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ সময় ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্রের ৭ হাজার বর্গ কি.মি. এলাকা যেমন মিরসরাই উপজেলার শাহেরখালী থেকে হাইতকান্দী পয়েন্ট; তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট; কলাপাড়া উপজেলার লতা চাপালি পয়েন্ট; কুতুবুদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবুদিয়া থেকে গণ্ডামারা পয়েন্টে ইলিশ মাছসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়াও দেশের ৩৭ জেলায় যথা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং গোপালগঞ্জ জেলার সংশ্লিষ্ট সব নদ-নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে।
নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশব্যাপী ‘ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০১৮’ পরিচালনা করা হবে। ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন; প্রধান প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ রক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সর্বোপরি অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর এ উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে ১-২ বছর মেয়াদে জেল কিংবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ হবে।
ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে।
পরে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।
ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে,২০১৭ সালে মা ইলিশ সঠিকভাবে সংরক্ষণের ফলে প্রায় ৪৭% ইলিশ ডিম দিয়েছে।
ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়।
দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০% বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত (১০-১৫%)। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও গত বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লাখ টন।
২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোলমডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের।
ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চলতি বছর দেশের ২৯টি জেলার ১১২টি উপজেলার মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৩,৯৫,৭০৯ জেলে পরিবারের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে বিনামূল্যে সর্বমোট ৭,৯১৪ টন ভিজিএফ চাল মঞ্জুর করেছে।
মৎস্যবান্ধব বর্তমান সরকারের এসব যুগোপযোগী ও প্রশংসিত কার্যক্রম বিগত কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষার ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টনে উন্নীত হয়েছে।
ইলিশ উৎপাদনের এরূপ সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে,জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল সরাসরি তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এ জন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
লেখক: ড.ইয়াহিয়া মাহমুদ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
এজি