প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, পদলেহনকারী ও তোষামোদকারীর দল বাংলার মাটিতে আর যাতে ইতিহাস বিকৃত না করতে পারে সেজন্য বাঙালি জাতিকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ইতিহাসকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। সেটাই প্রমাণিত হয়েছে আজ। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে। যতই তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হোক, ইতিহাস তার স্থান ঠিকই করে নেবে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি পুরো বাঙালি জাতি, সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব শক্তিকে সম্মানিত করেছে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে’ স্থান পাওয়ায় গতকাল শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক কমিটি আয়োজিত বিশাল সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বেলা পৌনে তিনটায় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাবেশের মূল অনুষ্ঠান। সভার শুরুতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর ‘ধন্য মুজিব ধন্য’, ‘শোন লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠ’ প্রভৃতি গান সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। সমাবেশে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেও চলে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ৭ই মার্চের ভাষণ বাজাতে গিয়ে আমাদের বহু নেতাকর্মী জীবন পর্যন্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণকে ইউনেস্কো আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা দেখে তাদের কী এখন লজ্জা হয় না? তারা একদিন এই ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ করেছিল। জানি না এদের লজ্জা-শরম আছে কি না? এরা তো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রেতাত্মা। স্বাধীন বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানের তোষামোদী ও চাটুকারের দল।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের দিনের কিছু সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। ওই মাহেন্দ্রক্ষণে তার মা বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিবের অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও আমার মা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ছায়া সঙ্গী হয়ে সবসময় পাশে থেকেছেন। যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেওয়ার জন্য তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন আমার মা বাবাকে (বঙ্গবন্ধু) শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিতে বলেন।
এর আগে অনেক নেতা ভাষণের জন্য অনেক পরামর্শ দিচ্ছিলেন, অনেকে লিখিত বক্তব্যও বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়েছিলেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বড় মেয়ে হিসেবে ওই সময় বাবার পাশে থাকার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার মা বঙ্গবন্ধুর পাশে একটি মোড়া নিয়ে বসে তার উদ্দেশ্যে বলেন- তোমাকে অনেকে অনেক কথা বলবে। দেশের জনগণের মুক্তির জন্য তুমি আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছ। তাই দেশের জনগণের জন্য তোমার মনে যে কথা আসবে সেই কথাই বলবে। তোমার থেকে দেশের জনগণের ভাল আর কে বেশি জানে।’
তিনি বলেন, আমার মা প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও আমার মনে হয়, ওই সময় আমার মা বঙ্গবন্ধুকে শ্রেষ্ঠ পরামর্শই দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার করতে গিয়ে যারা জীবন দিয়েছেন সেই সব নেতাকর্মীদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর কোন ভাষণ এতোদিন এতো ঘন্টা বাজানো হয় আর মানুষ শোনে এটা কিন্তু কোনদিন হয়নি।
৭ই মার্চের স্বীকৃতির গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি শুধু স্বীকৃতিই নয়। বিশ্ব দরবারে এই ভাষণের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ইতিহাসও প্রতিশোধ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এর আগে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা ক্ষমতায় থেকে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে পরাজিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু অপশক্তিরা তা পারেনি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলতে হয় না। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলে যে একটি দেশের উন্নয়ন হয়, তা আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে তুলবো। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবো। সেটাই আজকে আমাদের প্রতিজ্ঞা।
শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে নাগরিক সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রবীণ নজরুল গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, প্রবীণ সাংবাদিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টর বিট্রিস কালদুল। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেওয়া ধন্যবাদ স্মারক পাঠ করেন এবং সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধির হাতে সেটি তুলে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশের আরও ৭৭টি ঐতিহাসিক নথি ও প্রামাণ্য দলিলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেও গত মাসে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করে ইউনেস্কো।
সমাবেশে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ ভাষণ নিয়ে নিজের লেখা সাড়া জাগানিয়া কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ আবৃত্তি করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। প্রয়াত সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি।
এছাড়া দেশের স্বনামধন্য শিল্পী শাহীন সামাদ, মমতাজ বেগম এমপি, সাজেদ আকবর ও চন্দনা মজুমদার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নানা ভাষায় অনুবাদ করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে : ড. আনিসুজ্জামান
সভাপতির বক্তৃতায় ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে মানব জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভাষণ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষ এ থেকে শক্তি অর্জন করতে পারে।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো বাংলাদেশি নামধারী পাকিস্তানিরা দেশে সক্রিয়। তাদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্থান দিয়ে ইউনেস্কো বাঙালি জাতিকে যেমন সম্মানিত করেছে, ঠিক তেমনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণকে মর্যাদা দিয়ে ইউনেস্কোও সম্মানিত হয়েছে।
সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ হলো মহাকাব্য। তিনি বলেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে দুর্লভ সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মাত্র ১৮ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্কুলে পড়াতে ৬টি ক্লাস নিতে হয়। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
সমাবেশে মানুষের ঢল
যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের দিশা দিয়েছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, তার সেই ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি উদযাপনের সমাবেশ ঘিরে সেই উদ্যান গতকাল মুখরিত হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে। শুধু আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমাবেশমুখী মিছিল সবার দৃষ্টি কাড়ে।
বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে মিছিল আসছিল; বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নেচে-গেয়ে যোগ দেন অনেকে। সমাবেশে আসা হাজার হাজার মানুষের গায়ে ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকার রঙ লাল-সবুজের গেঞ্জি ও টুপি। সবার হাতে ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। এমনকি সমাবেশের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরে এসেছিলেন জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙা শাড়ি। তবে নাগরিক এই সমাবেশে মানুষের ঢল নামায় রাজধানীর অধিকাংশ স্থানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও পথচারীরা।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১ : ৩০ পিএম, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ রোববার
এইউ