ফিচার

চলেই গেলেন আহমেদ আলী চাচা

আমার ফরজ আদায়ের গল্প

কুমিল্লায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী, মুক্ত কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক, মুক্তিকালীন পূর্বাঞ্চলের যুব শিবিরে চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বারকাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট লেখক, সুরসম্রাট ড. উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জীবনীগ্রন্থ রচয়িতা, ভাষা সৈনিক প্রবীণ আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এডভোকেট আহমেদ আলী।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এডভোকেট আহমেদ আলী (আহাম্মদ আলী) চাচা।

তাঁর কাছে গেলেই গল্প করতেন জাতির জনকের ঐতিহাসিক ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনাদর্শ নিয়ে। মূলত চাচার কাছ থেকেই আমি খুব নিবিড় ভাবে জানতে পেরেছি জাতির জনকসহ এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস।

জানতে পেরেছি সুরসম্রাট ড. উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জীবনী, কুমিল্লা সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ ঐতিহাসিক বিষয়াদি।

সেই হিসেবে জনাব আহমেদ আলী চাচাকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।তিনি কতটা মুজিব আদর্শের সৈনিক ছিলেন তারই প্রমাণ দিয়ে গেলেন তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে।

আহমেদ আলী চাচা হয়তো মনে মনে সেই ঐতিহাসিক দিনটি স্বচক্ষে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন।

স্ত্রীর প্রয়াণের পর থেকে এবং বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ধীরে ধীরে শারিরীক ভাবে দুর্বল হতে থাকেন কয়েক বছর ধরে। গত কয়েক বছরে কয়েক দফায় গুরুতর অসুস্থ হয়েও হয়তো তার মনের বাসনা পূর্ণ করতেই, এই ঐতিহাসিক দিনটি দেখানোর জন্যই আল্লাহ পাঁক তাকে হায়াত দরাজ করেছিলেন।

গতকাল মহা ধুমধামে দেশব্যাপী পালিত হয়েছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দিবস এবং সেই সাথে জাতির জনকের জন্ম শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মুজিব বর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১০ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার।

ঠিক ঐতিহাসিক দিনটি দেখার পর ওই রাতেই পরপারে পারি জমান আমার প্রিয়, সকলের প্রিয় আহমেদ আলী চাচা। আমরা তাঁর বিদেশি আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজ থেকে এক দশক আগের কথা। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সংবাদ পত্র দৈনিক আমাদের কুমিল্লায় সুর সম্রাটকে নিয়ে আমার একটি লিখা প্রকাশ হয়। এতে একটি জায়গায় আহমেদ আলী চাচার একটি অবদানের কথা আমি উল্লেখ করি। অর্থাৎ সুর সম্রাটের জন্মভূমি শিবপুরে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজের নামকরণ সুর সম্রাটের নামে করেছিলেন আহমেদ আলী চাচা। যা অনেকেই জানতেন না বা জানলেও স্বীকৃতি দিতেন না। এমতাবস্থায় আমার লিখায় এই সত্যটি প্রকাশ পাওয়ায় তিনি লিখাটি পড়ে আপ্লূত হন!

অতঃপর তিনি সেই পত্রিকা অফিসে ফোন দিয়ে আমার নম্বর নিলেন এবং আমাকে কল করে দোয়া করলেন। বল্লেন কে তুমি বাবা, তোমার বাড়ি কই? কেউতো বলে না, তাহলে তুমি জানলে কি করে? চাচার সেই ফোন আমার কাছে এক মহামূল্যবান পুরষ্কারে পরিণত হয়েছিল! আমার কাজের আগ্রহ বাড়ায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।

যাইহোক সেই থেকে শুরু। এরপর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে পরিবারটির সাথে। বলতে গেলে পারিবারিক সদস্যের মতোই।

২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লায় আমার প্রাণের সংগঠন ‘ ঐতিহ্য কুমিল্লা ‘ আয়োজিত সুর সম্রাটের স্মরণ উৎসবে চাচাকে সম্মাননা জানাবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জীবনীগ্রন্থ রচয়িতা হিসেবে তাকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

গেলো ৮ডিসেম্বর ২০১৯ ঐতিহাসিক কুমিল্লা মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে চাচার বাসার আঙিনায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আমি আমন্ত্রিত হয়ে অংশ গ্রহণ করি, ফুলেল শুভেচছা জানাই।

চাচা এই বয়সেও আমাকে দেখেই চিনতে পারেন। হৃদয়ে ধারণ করা বলতে একটা কথা থেকেই যায়। হয়তো তিনি আমাকে সেভাবেই নিয়েছিলেন। নাহয় তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আমাকে দেখেই বল্লেন, অ– ইমরুলে আইছ? বও বও। এটাই ছিল চাচার আমার শেষ মুখোমুখি!

চাচার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের কাজলিয়া গ্রামে

অবশেষে একটি কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা বলি। গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব ভার আমার উপর চাপে। মাত্র সাড়ে চার মিনিটে ঐতিহাসিক কুমিল্লাকে তুলে ধরার বিষয়টি আমার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তার পরও আমি যথাসম্ভব দ্রুতসময়ে তা মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করি।

একপর্যায়ে প্রামাণ্যচিত্রটি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে প্রদর্শিত হয় এবং অনেকের প্রশংসা পাই।

এই প্রামাণ্যচিত্রতে কুমিল্লার অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির কথা ও ছবি তুলে ধরতে চেষ্টা করি। মুক্তি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ও কুমিল্লায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী হিসেবে আহমেদ আলী চাচাকে এখানে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং রাখি। বিপত্তি এখানেই! সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আপত্তি তুললেন এই নামটি এখানে আসায়! তার মতে রাজনৈতিক ভাবে কেউ মাইন্ড করতে পারেন!

মনে মনে বললাম, হায়রে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি! এর জন্যইকি আহমেদ আলীরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে ছিলেন? এই ইমরুল কারোর ব্যক্তিগত লেজুড়বৃত্তি করতে এই পেশায় আসেনি। যা সত্যি তা অকপটে বলার মানসিকতা রাখে। না পারলেও মনে মনে ঘৃণা করে।

যাইহোক আমি ওই ব্যক্তিকে চাচার ছবি এই প্রামাণ্যচিত্রতে রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরলে তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়ে বল্লেন, শিব নারায়ণ দাশের ছবি দিতে পারতেন।

আমি নীরব রইলাম। আবারও মনে মনে বল্লাম, ভাই আপনাকে কি করে বুঝাই যা আমার নিজ চোখে দেখেছি।

আহমেদ আলী চাচার স্ত্রী মারা যাবার কিছুদিন পরের কথা। আমি চাচার বাসায় বসা। এমন সময় বাসায় গেলেন সাবেক আইন মন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু। তিনি চাচাকে কদমবুচি করলেন, কথা বলে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর, দাড়িগোঁফ ওয়ালা এক ভদ্রলোক বাসায় প্রবেশ করলেন। চাচা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানতে পেলাম তিনি আমাদের জাতীয় পতাকার রূপকার শিব নারায়ণ দাশ। অনেক কথা হলো। গল্প হলো।

জানতে পেলাম জাতির জনকের অনেক প্রিয় ছিল আহমেদ আলী চাচার স্ত্রীর হাতের বানানো চা। শুধু জাতির জনকেরই নয় ততকালীন সময়ে হেন কোনো রাজনৈতিক নেতা নেই তার হাতের রান্না খাবার এবং চায়ের স্বাদ উপভোগ করেন নি! এমনকি শিব নারায়ণ দাশ নিজেই তা অকপটে বলনেন। এই মানুষটির প্রয়াণের খবর পেয়েও যথা সময়ে আসতে না পারায় তিনি নিজেকে লজ্জিত ও ব্যথিত বোধ করেন!

এসময় তিনি বলেন, ‘আজ আমি এখানে এসে ফরজ আদায় করলাম!’

সেদিন চাচা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, একজন হিন্দু মানুষের মুখে ফরজ আদায় কথাটার গুরুত্ব তুলে ধরে আমি যেন কিছু একটা লিখি। কারন চাচা নিজেও আমার লিখা পছন্দ করতেন।

সুতরাং আজ চাচার অবর্তমানে শিব নারায়ণ দাশের বলা ফরজ আদায়ের কথাটি তুলে ধরতে পেরে আমি নিজেও যেন ফরজ আদায় করলাম!

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল
ঐতিহ্য কুমিল্লা

Share