চাঁদপুর

চাঁদপুর রেলওয়ের ইতিহাস

১৮৯২ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি। প্রতিষ্ঠার পর এই কোম্পানির প্রধান কাজ ছিল আসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা। অর্থাৎ রেল যোগাযোগের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বন্দর সুবিধা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেসময় বাংলার প্রধান শহর ছিল কলকাতা। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুরই মূলে ছিল এই শহর। তাই চট্টগ্রামে বন্দর সুবিধা নিশ্চিত করা গেলেও বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে কলকাতামুখী হতেই হতো। কিন্তু আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের কোনো ট্রেন কলকাতা পর্যন্ত চলাচলের ব্যবস্থা করা কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। তাহলে অত্র অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কলকাতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে কীভাবে?

মূলত চাঁদপুরে রেলপথ নির্মাণ করা হয় কলকাতার সাথে যোগাযোগ সহজ করার জন্য। যেহেতু রেলপথে কলকাতা পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সিদ্ধান্ত নিল স্টিমার সার্ভিস চালু করা হবে। এজন্য চাঁদপুরের মেঘনা পাড় পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া এই মেঘনা ঘাট স্টেশনের মাধ্যমে ঢাকা, রাজশাহী এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যাবে। সেসময় গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ট্রেনে করে কলকাতা রুট ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। ঢাকা থেকে মানুষ সকালে ট্রেনে করে নারায়ণগঞ্জ আসত। সেখান থেকে স্টিমারে করে দুপুর নাগাদ পৌঁছত গোয়ালন্দ ঘাটে। আর গোয়ালন্দ থেকে মেইল ট্রেনে সন্ধা নাগাদ পৌঁছন যেত কলকাতায়। আর এই সুবিধা নিশ্চিত হয় আরো ১২ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮৪ সালে। যদিও গোয়ালন্দ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে ১৮৭০ সালে। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা ট্রেন চালু হয় ১৮৮৪ সালে।

আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ঠিক এমনই পরিকল্পনা করল। চট্টগ্রাম বা পূর্বাঞ্চল থেকে মানুষ ট্রেনে করে চাঁদপুরে আসবে। সেখান থেকে স্টিমারে করে গোয়ালন্দ, তারপর গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে করে কলকাতা। আবার আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে সরাসরি চাঁদপুর থেকে কলকাতা পর্যন্তও স্টিমার সার্ভিস থাকবে। আর এটাই ছিল কলকাতার সাথে যোগাযোগ রক্ষার সবচেয়ে সহজতর উপায়। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এই লাইনের নির্মাণ আগে শুরু করে। সেখান থেকেই এই রেলপথের গুরুত্ব বোঝা যায়।
লাকসাম-চাঁদপুর রেল সেকশন

ছবি: চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন

আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পরই দুটো লাইন নিয়ে একসাথে কাজ শুরু করে। আর এই দুই লাইনের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে একটি হলো কুমিল্লা-চট্টগ্রাম ১৫০ কিলোমিটার মিটারগেজ এবং অপরটি লাকসাম-চাঁদপুর ৫০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ। দুটি লাইনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৯২ সালে। সেই ১৩০ বছর আগে লোহালক্কড় নিয়ে দেশীয় শ্রমিকেরা নেমে পড়লেন কাজে।

বাংলাদেশে রেলওয়ের ঐতিহাসিক কাজগুলো এমন একটা সময়ে সম্পাদিত হয়েছে যখন এ দেশের মানুষ ছিল সুবিধাবঞ্চিত। তিনবেলা খাওয়া জুটত না অধিকাংশরই। জমি ছিল কিন্তু চাষাবাদ করতে জানত না, পুকুর ছিল কিন্তু মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতি জানা ছিল না। মানুষ তখন পুরোটাই ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সেই সময় যখন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর লোহালক্কড় এলো ইংল্যান্ড থেকে আর শুরু হলো মহাযজ্ঞ, তখন এ দেশের অবহেলিত মানুষের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রেলকেন্দ্রিক যে কাজগুলো তখন সম্পাদিত হচ্ছিল তার সবটাই ছিল এদেশের মানুষের কল্পনার বাইরে। তাই তো গ্রামীণ লোককথা, কল্পকথা আর জারি গানে রেলের প্রভাব রয়ে গেছে। প্রভাব পড়েছে এ দেশের কবিতা ও সাহিত্যাঙ্গনেও।

১৮৯২-৯৫ সাল পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নির্মাণকর্মীরা। জানুয়ারি মাস নাগাদ কাজ সমাপ্ত হলো। কিন্তু তখনও চট্টগ্রাম-কুমিল্লা সেকশনের কাজ চলমান রয়েছে। এই সেকশনের কাজ শেষ হলে ১ জুলাই দুটি লাইন একসাথে উদ্বোধন করা হয়। আর এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয় কুমিল্লার লাকসামে।

উদ্বোধনের দিনই চট্টগ্রাম থেকে লাকসামে ট্রেন এলো। সেখান থেকে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে ছুটে চলল চাঁদপুর অভিমুখে। চাঁদপুরে মেঘনা ঘাটে আগে থেকে ভেড়ানো ছিলো স্টিমার। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে স্টিমারে চড়লো। স্টিমারে গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছে মেইল ট্রেনে রাত দশটা নাগাদ কলকাতায় পা রাখল। ১০ দিনের যাত্রাপথ নেমে এলো একদিনে। পরে অবশ্য আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে চাঁদপুর থেকে সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত স্টিমার চালু করা হয়। চট্টগ্রামের সাথে ঢাকার যোগাযোগের জন্যও এটি ছিল সবচেয়ে সহজ পথ। প্রতিদিন হিঁস হিঁস করে বাশি বাজিয়ে দুটি মেইল ট্রেন ছুটে চলত এই রুটে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই সেকশনটি বেশ জমজমাট ছিল।

দেশভাগের পর কলকাতা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে এই সেকশনটি গড়ে ওঠে ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। সেই ঘাট, সেই স্টেশন আজও আছে। নেই শুধু সেই কয়লার ট্রেন আর ঘাটে অপেক্ষমান কলকাতাগামী স্টিমার। আজ এই রুটে আর ধোঁয়া উগড়াতে উগড়াতে বাষ্পশকট ছুটে চলে না। ট্রেনের সাইরেন শুনে সময় গণনা করার দিনও চলে গেছে অনেক আগেই। প্রায় ১৩০ বছর পর ট্রেন নিজেই এখন তার সময় রক্ষা করতে পারে না। তপ্ত দুপুরে যাত্রীদের কোলাহল, ক্লান্ত কুলির ডাক আর পসরা সাজিয়ে বসা ব্যস্ত হকারের দোটানা সুর আজ আর শোনা যায় না। এখন ঘাটে অপেক্ষা করে ঢাকাগামী বিলাসবহুল সব লঞ্চ। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন সেই দিনগুলোর কথা আজও অনেককে স্মৃতিকাতর করে তোলে।

দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে এই লাইনের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে পড়েছিল। ২০১৫ সালে লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত সমগ্র লাইন সংস্কার করা হয়। প্রাচীনতম এই লাইনে বর্তমানে তিনটি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে। চাঁদপুর থেকে লাকসাম পর্যন্ত ১২টি মধ্যবর্তী স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্টেশন হলো চাঁদপুর কোর্ট, মধুরোড, হাজীগঞ্জ, মেহের ও চিতোষী রোড।

লাকসাম জংশন থেকে চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম সেকশনের মাঝখান দিয়ে নোয়াখালীগামী রেলপথ বের করে নিয়ে আসা হয়। ফলে লাকসাম চতুর্মুখী জংশনে পরিণত হয়। নোয়াখালী হচ্ছে লাকসাম নোয়াখালী সেকশনের শেষ স্টেশন। ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৫০ কিলোমিটার মিটারগেজ এই লাইনটি উদ্বোধন করা হয়। কৃষিপণ্য ও মৎস্য পরিবহনের জন্য খুব দ্রুতই এই সেকশনটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে এক গেজেটের মধ্য দিয়ে নোয়াখালী রেলওয়ে কোম্পানি সরকারিকরণ করা হয়। এরপর ১৯০৬ সালের ১ জানুয়ারি কোম্পানিকে আসাম বেঙ্গলে রেলওয়ের সাথে একীভূত করা হয়।

নোয়াখালী-লাকসাম সেকশনের মূল স্টেশনগুলো হলো মাইজদী কোর্ট, চৌমুহনী, বজরা, সোনাইমুড়ি, নাথের পেটুয়া ইত্যাদি। রেল যোগাযোগ প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর থেকেই জেলা হিসেবে নোয়াখালীর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে শহরজুড়ে, গড়ে উঠতে থাকে ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান। এভাবেই রেল যোগাযোগ নোয়াখালী জেলার আমূল পরিবর্তন সাধন করে।

কে.এইচ ৩০ এপ্রিল,২০২১;

Share