পরম করুণাময় মহান আল্লাহ তায়ালার অনেকগুলো সিফাতি বা গুণবাচক নামের মধ্যে দুটি হল, গফুর ও গাফফার; যার অর্থ, মহা ক্ষমাশীল।
বান্দা যত অপরাধ কর্মই করুক, ক্ষমতার আঁধার যিনি, মহামহিম যিনি, যার কাছে দয়া ও ক্ষমার অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে, তাঁর কাছে যদি পাপী বান্দা অনুনয়-বিনয় করে, প্রাণের পুরোটা আবেগ উজাড় করে একটু ক্ষমা প্রার্থনা করে, তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন।
শুধু ক্ষমা করেই খ্যান্ত হন না, তার প্রতি সন্তুষ্টির ঘোষণা দেন। তওবাকারীর জন্য প্রভূত পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছেন তিনি।
আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেন, নিশ্চয় তিনি আল্লাহ, ক্ষমাশীল, পরম ক্ষমাপরায়ণ। নিশ্চয়ই আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। (সূরা: হজ্, আয়াত: ৬০)
ধৈর্যধারণকারীর প্রতি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে বলেন, যারা ধৈর্য্ধারণ করেছে ও সৎকার্য করেছে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। সূরা: হুদ আয়াত: ১১)
আমাদের দ্বারা অনবরত গোনাহ হয়ে যায়। কথা বললে গোনাহ হয়। চোখ খুললে গোনাহ হয়। শুনলে গোনাহ হয়।
যেই মহান স্রষ্টা এত ভালোবেসে, সুন্দর অবয়ব দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, গোটা সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বানিয়েছেন, মোমিন বানিয়েছেন, কুল মাখলুকাতের মধ্যে সেরা মাখলুক, মহামানব রাসূলে আরাবি হুজুরে আকদাস (সা.)-এর উম্মত বানিয়েছেন, আমরা সেই মহান আল্লাহর কতটুকু কৃতজ্ঞ হতে পেরেছি? পারিনি। বরং বারবার তার নাফরমানিই করেছি। চরম অবাধ্য হয়েছি।
কতবার তাঁর সঙ্গে ওয়াদা করেছি, প্রভু, আর অপরাধ করব না, ভুল পথে পা বাড়াব না, কৃপা করে এবার অন্তত ক্ষমা কর!
ওয়াদা ভঙ্গ করে ফের একই পথে হেঁটেছি; তবুও তিনি পাকড়াও করেননি। তাত্ক্ষণিক শাস্তি দেননি। সুযোগ দিয়েছেন। সঠিক পথে ফিরে আসার অবকাশ দিয়েছেন।
অতঃপর, নিজের গোনাহে অনুতপ্ত হয়ে যখন আমরা প্রভুর কুদরতি কদমে লুটিয়ে পড়েছি, অশ্রুসিক্ত মোনাজাতে ক্ষমা প্রার্থনা করেছি, তখন তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমাদের তওবাতে খুশি হয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবায় তার চেয়েও অনেক বেশি খুশি হন। (বোখারি : ৬৩০৯) সুবহানাল্লাহ!
গোনাহের বোঝা ভারি করতে করতে নিজেদের প্রতি আমরা কি কম জুলুম করেছি? তবুও দয়ার প্রভু ঘোষণা করেন,(হে নবী,আপনি) বলুন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু! (সূরা জুমার, আয়াত: ৫৩)
অন্যত্র বলেন, তিনিই তো স্বীয় বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপগুলো ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা, আয়াত: ২৫)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, হে ঈমানদাররা, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর; তবেই তোমরা নিঃসন্দেহে সফলতা লাভ করবে। (সূরা নূর, আয়াত : ৩১)
আর যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, অতঃপর সৎ পথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল। (সূরা: ত্বহা, আয়াত: ৮২)
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা কর এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি দিনে ১০০ বার তওবা করি।(মুসলিম : ৭০৩৪)
আল্লাহর রাসূলের কোনো গোনাহ ছিল না। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ। তবুও তওবা করতেন। এর দ্বারা মূলত স্বীয় উম্মতকে ক্ষমাপ্রার্থনা শেখাতেন এবং আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা আদায় করতেন।
আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করলে তিনি শুধু ভুলগুলোই ক্ষমা করেন না, বরং তিনি বান্দার সমস্ত দোয়াও কবুল করতে থাকেন। এ সম্পর্কিত একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে বিখ্যাত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (রহ.)।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তখন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। একবার তিনি দূরে কোথাও সফরে বেরুলেন। যাত্রাপথেই রাত হয়ে গেল। শহরটি ছিল অচেনা। পরিচিত কেউ নেই। তবে, তখনও সবাই ইমাম আহমদের নাম জানত না। তার প্রসিদ্ধি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তবে, এখন তিনি যেখানে অবস্থান করছেন, এখানকার কেউ আগে কখনও তাকে দেখেনি। নামটাই শুনেছে মাত্র। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, রাতটা মসজিদেই কাটিয়ে দিবেন। পরিচয় গোপন করে মসজিদে থাকতে গেলে মসজিদের খাদেম তাকে আশ্রয় দিল না। মসজিদ থেকে বের করে দিল। অপরিচিত লোকের ভার কেইবা নিতে চায়! খাদেমও নিল না।
এক রুটি বিক্রেতা ব্যাপারটি লক্ষ্য করল এবং কাছে এসে সবকিছু শুনে অচেনা ইমাম আহমদকে আশ্রয় দিল। ইমাম আহমদ রুটি বিক্রেতার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন এবং অবাক হলেন, সে দেখা হওয়ার পর থেকেই অনবরত ইস্তেগফার করছে।
কৌতূহলি হয়ে ইমাম আহমদ (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, এই যে তুমি এত ইস্তেগফার করছ, এর বিনিময়ে কি কিছু পেয়েছ?
রুটি বিক্রেতা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, এই ইস্তেগফারের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা একটি দোয়া ছাড়া আমার সমস্ত দোয়া কবুল করেছেন।
তিনি জানতে চাইলেন, কী সেই দোয়া?
রুটি বিক্রেতা উত্তর দিল, এই যুগের শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ, আলেম ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে আমার দেখার খুব ইচ্ছে । কিন্তু আজও তাকে দেখতে পারলাম না! আল্লাহ তায়ালা আমার এই দোয়াটি কবুল করেননি।
তখন ইমাম আহমদ (রহ) বললেন, ইস্তেগফারের বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তোমার এই দোয়াটিও কবুল করেছেন। আমিই সেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, যার সাক্ষাৎ তুমি কামনা করছ। (আল জুমুআ ম্যাগাজিন; ভলিউম: ১৯, ইস্যু:৭)
অনেকে মনে করেন, আমি তো অনেক গোনাহ করে ফেলেছি, হেন কোনো পাপকাজ নেই, যা আমি করিনি, আমাকেও কি আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন?
অবশ্যই করবেন। আল্লাহ তায়ালা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বান্দার সমস্ত তওবাই গ্রহণ করবেন।
নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘মৃত্যুর যন্ত্রণা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবা কবুল করেন।’ (তিরমিজি : ৩৮৮০)।
তওবা আমরা কীভাবে করব? এর পদ্ধতি কী?
পদ্ধতি খুব সহজ। তওবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ফিরে আসা,প্রত্যাবর্তন করা। পরিভাষায় গোনাহের কাজ ছেড়ে দিয়ে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহমুখি হওয়াকে তওবা বলা হয়।
ইস্তেগফার তো আমরা সবাই পারি। প্রথমে মুখে মুখে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়া। এর অর্থ হল, হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি! অর্থটা মনে রাখা আর মুখে দোয়াটি পড়া।
সেই সঙ্গে পূর্বের হয়ে যাওয়া সমস্ত গোনাহ স্মরণ করতে থাকা আর অনুতপ্ত হওয়া এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, হে আল্লাহ, এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও, শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আর গোনাহের কাজে লিপ্ত হব না!
এরপরে নেক আমল করতে থাকা। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তায়ালা আমাদের তওবা কবুল করে ভুলগুলো ক্ষমা করে দিবেন!