বিশেষ সংবাদ

আসলেই তারা স্বর্ণকিশোরী, প্রশাসনও তাদের কথা শোনে!

তোমরা কেন স্বর্ণকিশোরী? প্রশ্ন শেষ না হতেই আতিয়া সানজিদা বলল, ‘মেয়েরা মানে আমরা অনেক দামি। বলতে পারেন স্বর্ণ বা সোনা যেমন দামি, কেনার পর সবাই যত্ন করে রাখে, মেয়েরাও তেমনি দামি। যত্ন করে গড়তে হয়। তাই তো আমরা স্বর্ণকিশোরী।’

দেশের এই স্বর্ণকিশোরীরা কাজ করছে কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। শুধু নিজের নয়, দেশের সব কিশোরীকে সুস্থ রাখার অঙ্গীকার করেছে স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের এই সদস্যরা।

চারটি শপথ নিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। এক. ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়। দুই. ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ নয়। তিন. ভাই আর বোন, পুষ্টিকর খাবারে সমান দুজন। চার. বয়স ১৫ বছর যখন, টিটি টিকার (ধনুষ্টংকার) পাঁচ ডোজের শুরু তখন। আর সবকিছুর মূল লক্ষ্য হলো নিরাপদ মাতৃত্ব।

সম্প্রতি ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বর্ষসেরা এবং দ্বিতীয় সেরাদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে। ২০১৪ সালের বর্ষসেরা মনামী মেহনাজ, দ্বিতীয় সেরা আতিয়া সানজিদা। শাহজিয়া শাহরিন ২০১৫ সালের বর্ষসেরা, নোশিন শারমিলি দ্বিতীয় সেরা। ২০১৬ সালের বর্ষসেরা দীপ্তি চৌধুরী এবং দ্বিতীয় সেরা ফারিহা ইসলাম। বছর শেষে কনভেনশনে যোগ দিয়ে সবাইকে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, আইসিটিসহ নানান বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই বর্ষসেরার খেতাব মেলে।

ঢাকার আতিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দীপ্তি, ছাতকের ফারিহা, বাগেরহাটের নোশিনসহ এই কিশোরীদের অকারণ দমকা হাসি, উচ্চ স্বরের কথা একটু সময়ের মধ্যে প্রথম আলোর পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে যায়। কথা হয় মাসিক নিয়ে সচেতনতা তৈরির বিষয়ে। একজন বলল, দোকান থেকে কিছু কিনলে পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দেয় না, কেবল স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গেলেই শুরু হয়ে যায় গোপনীয়তা, ফিসফাস।

বিয়ে করা, সন্তান নেওয়া একটি মেয়ের নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী হওয়া উচিত বলে মনে করেন ওরা।

মেহেরপুরের মেয়ে রোকেয়া। বর্ষাকালে রান্নাঘরের কোনায় মাসিকের কাপড় শুকাতে দিয়েছিল। ভালো করে না শুকাতেই পরের দিন তা পরে সে স্কুলে যায়। কাপড়ে একটি জোঁক লেগে ছিল। রোকেয়া বুঝতে পারছিল তার অস্বস্তি হচ্ছে, বাড়ি যাবে বলেছে, কিন্তু শিক্ষককে কারণ বলতে লজ্জা পায়। জোঁক মাসিকের রাস্তা দিয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকে গেলে মারা যায় রোকেয়া। স্বর্ণকিশোরীরা রোকেয়াকে নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি অ্যানিমেশন কার্টুনে কণ্ঠ দেয়। এ কার্টুন দেখিয়ে অন্যদের সচেতন করার চেষ্টা করে তারা।

স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফারজানা ব্রাউনিয়া। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কিশোর-কিশোরী সুরক্ষা ক্লাব পরিচালিত হয়, এই ক্লাবগুলোই পরিচালনা করছে স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন। ক্লাব গঠনে সহায়তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চ্যানেল আই।

১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েরা স্বর্ণকিশোরী এবং ছেলেরা স্বর্ণকিশোর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। প্রতি উপজেলায় ক্লাবগুলোতে আছে ২০ জন কিশোরী এবং ১০ জন কিশোর। স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষে স্কুল ছুটির পর বা টিফিনের ফাঁকে চলে ক্লাবের কার্যক্রম। বর্তমানে ৪৯১টি ক্লাব চলছে সারা দেশে।

স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে। চলতি বছরে দেশের ৪ হাজার ৫৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদকে এর কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হবে।

মেহনাজ বলে, ‘ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত হয়ে এ পর্যন্ত ২০টির বেশি জেলায় গিয়েছি। অনেক জায়গার কিশোরীরা জানেই না মাসিকের সময় অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার করা ঠিক না। জানানোর পর ওই কিশোরীরা প্রতিজ্ঞা করে এ তথ্য অন্যকে জানাবে। এভাবে এখন পর্যন্ত ৭ লাখ ৩২ হাজার কিশোর-কিশোরী যুক্ত হয়েছে। আমরা জালের মতো শুধু একজন থেকে আরেকজনকে যুক্ত করছি।’

একটি ক্লাবের সদস্যরা নিজেরাই ঠিক করেছে টিফিনের টাকা থেকে প্রতিদিন দুই টাকা করে জমিয়ে স্যানিটারি প্যাড কিনে স্কুলের দরিদ্র কিশোরীদের দেবে।

আতিয়া জানাল, এখন সে তার বাবাকে স্যানিটারি প্যাড লাগবে, তা জানাতে কোনো দ্বিধা করে না। চঞ্চল নামের এক কিশোর ফেসবুক পেজে কিশোরী বন্ধুদের মাসিকের সময় সবাই যাতে তাদের যত্ন নেয়, সে আহ্বান জানিয়েছে।

স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর শান্তা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যে কিশোর ও কিশোরীরা যুক্ত হয়েছে, শুধু তাদের জীবনটাও যদি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, তাও কিন্তু অনেক বড় একটা কাজ হবে।

এই কার্যক্রমে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীরা এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্কসহ নানান দেশে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছে। অনেক বড় বড় পরিকল্পনা করছে নিজেরাই।

ফাউন্ডেশনের কিশোর-কিশোরীরা এ পর্যন্ত শতাধিক বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে বলে দাবি করে। মূলত তাদের কাজ স্থানীয় প্রশাসনকে তথ্যটি জানানো। তারপর প্রশাসনের উদ্যোগেই বিয়ে ঠেকানো হয়।

প্রশাসন তোমাদের কথা শোনে?—এমন প্রশ্নের উত্তরে গাজীপুরের শাহজিয়া বলে, ‘আমাদের নিজস্ব পরিচয় আছে। প্রশাসনের কাছে ফোন করে শুধু বলি, স্বর্ণকিশোরী ফাউন্ডেশন থেকে বলছি। আর কিছু বলতে হয় না। এখন অন্যরা আমাদের সামনে বাল্যবিবাহের কথা বলতেও ভয় পায়।’

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ০০ পিএম, ২৫ জুন ২০১৭, রোববার strong>
ডিএইচ

Share