কচুয়া

চাঁদপুরের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট আশেক আলীর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম

চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট ও কচুয়ার গুলবাহার আশেক আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আশেক আলী খান বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ।

শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে পরিচিত হলেন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, ফরিদপুর জিলা স্কুল, বরিশাল জিলা স্কুলে ও সর্বশেষ ঝালকাঠির সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট ও সেকালের ইংরেজি জানা বাঙালী সাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন।

আশেক আলী খান ১৮৯১ সালে চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তখন গুলবাহার গ্রামের নাম ছিলো গোয়ালভাওর। তার পিতা আইনউদ্দিন খান ও মাতা আলেকজান বিবি ওরফে টুনি বিবি। আশেকের চার মেয়ে ও চার ছেলে। এদের অধিকাংশরাই শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তার ৩য় ছেলে বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর ।

ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর বর্তমানে চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনে পরপর তিনবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার অপর সন্তান শিক্ষাবিদ ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বড় ছেলে মেসবাহ উদ্দিন খান সাবেক সরকারি কমকর্তা ও সাবেক এমপি। ২য় সন্তান ড.বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সাবেক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৪র্থ ছেলে ড.হেলাল উদ্দিন খান সামসুল আরোফীন, অধ্যাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯১০ সালে ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রচলন হয়। আশেক আলী খান এ প্রচলনের ২য় বছর ১৯১১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলা শহরে অবস্থিত বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তৎকালিন সময়ে ওই বিদ্যালয়ে তার শ্রেণিতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম। ভিন্ন ধর্মের হয়েও শ্রেণিতে সর্বদা প্রথম স্থানে ছিলেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরিবারে অভাব-অনটনের মধ্যে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরপরই ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু শুরু করেও শেষ করতে পারেননি। পড়ায় বিরতি দিয়ে পর পর দুটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে কলকাতায় সিটি কলেজে বিএ ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করে ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৯ সালে বিটি পড়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

নিজ গ্রামে গুলবাহারে আশেক আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৫ সালে এই স্কুল সরকারী অনুমোদন পায়। তার স্থাপিত আশেক আলী খান হাইস্কুল হতে তিনি জীবিত থাকবস্থায় অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের উদ্বুদ্ধ করে যে শিক্ষার আলো তিনি জ্বালিয়েছিলেন তা সত্যিই শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।

তৎকালীন এই বিষয়ে তাঁকে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশেক আলী খান প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় কচুয়া থানার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। তিনি প্রথমে চাঁদপুর গনি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, ফরিদপুর জিলা স্কুল, বরিশাল জিলা স্কুলে ও সর্বশেষ ঝালকাঠির সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। জন্মস্থান গুলবাহার গ্রামে স্কুলের পাশে ডাকঘর প্রতিষ্ঠ করেন।

গ্রামীন রাস্তাঘাট উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত রাখতে মসজিদ গড়েছেন। হাঁস-মুরগি পালনের জন্য উন্নত পদ্ধতি, কৃষিক্ষেত্রে ভাল ফলনের জন্য বিভিন্ন জৈবসারের ব্যবহার, উন্নতমানের বীজের সরবরাহ, পল্লী বিদ্যুত আনয়ন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, রাস্তার পাশে গাছ রোপণ, মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদি কাজেও তার ভূমিকা ছিলো। আশেক আলী খান ২ আগস্ট ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর আরাধ্য কাজ এগিয়ে চলে সুযোগ্য সন্তানদের সহায়তায় লেখকঃ রিয়াজ শাওন -বিতর্কীক,চাঁদপুর সরকারি কলেজ।

Share