যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত…। না, পৃথিবী থেকে অন্যায় দূর হয়নি। এখনো অত্যাচারিত হচ্ছে মানুষ। তবু ‘চির বিদ্রোহী বীর’ ‘চির-উন্নত শির’ কাজী নজরুল ইসলামকে শান্ত হতে হয়েছিল। মৃত্যু চিরতরে থামিয়ে দিয়েছিল তাকে। আজ ১২ ভাদ্র প্রেম সাম্য ও মানবতার কবির ৪৭তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের আজকের দিনে পৃথিবী থেকে প্রস্থান গ্রহণ করেন তিনি।
জীবদ্দশায় বিদায়ী বার্তা দিয়ে অভিমানী নজরুল লিখেছিলেন, ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’ বাংলা সাহিত্য সংগীতের ভা-ারকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করে সত্যি সত্যি বড় একাকী নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও, তার অমূল্য সৃষ্টির আলোয় এখনো পথ দেখে চলেছে বাঙালি। আজও অনন্ত অনুপ্রেরণার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। প্রতি বছরের মতো আজও প্রয়াণবার্ষিকীর দিনে কবিকে গভীর শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করবে দুই বাংলা। রাজধানী ঢাকায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
বহু প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো, ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবির ভাষায়: ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনর্মহাবিপ্লব হেতু/এই ¯্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’ তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’ প্রেম দ্রোহের দ্বৈতসত্তায় নিজেকে গড়েছিলেন। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারাজীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ আজও তাই সমান প্রাসঙ্গিক।
কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম হাতে যে প্রতিবাদ গড়েছিলেন, আজও তা ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কবির গান কবিতা বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। নজরুলের কবিতা সাম্যের কথা বলে। মানবতার কথা বলে। ধর্ম ও জাত পাতের নিকুচি করেছেন কবি। ধর্মের নামে অধর্ম, জাতের নামে বজ্জাতির শ্রেষ্ঠতম প্রতিবাদ তার কবিতা ও গান। কবি ‘মানুষ’ পরিচয়টিকে রেখেছেন সবকিছুর ওপরে। তার ভাষায় : ‘জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহনশীল,/তাকে কি ভাই ভাঙ্গতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।/যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,/আজ নয় কাল ভাঙ্গবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া…।’ মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া কবি নারীর প্রতিও ছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধাশীল। তাই তো তিনি লিখতে পারেন, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
কাজী নজরুল ইসলামের নিজের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতিদরিদ্র পরিবারে। মক্তবে পড়ালেখা দিয়ে শিক্ষা জীবনের শুরু। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাকে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার সাহিত্যচর্চা।
নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি লিখেছিলেন, …আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল…। কাছাকাছি সময়ে রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার সাড়া জাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈ চৈ ফেলে দেয় সর্বত্র।
নজরুল গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তার প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তার সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনা নিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হৈনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সংকলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সংগীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার রেখে গেছেন কবি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
তবে জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল)। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
আজ রবিবার সকালে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সংগঠন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হবে গভীর শ্রদ্ধা। বাংলা একাডেমির অবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে নজরুল বিষয়ক একক বক্তৃতা করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আকতার কামাল। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে থাকবে নজরুলের গান ও কবিতার পরিবেশনা।
ছায়ানটে আজ সন্ধ্যা সাতটায় থাকবে নজরুলের ভক্তি রসের গান। একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তির মাধ্যমে নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো হবে। আয়োজক ছায়ানটের শিল্পীরা ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল এতে অংশ নেবে। এসবের বাইরেও দিনভর নানা আয়োজনে স্মরণ করা হবে কাজী নজরুল ইসলামকে।
মোরসালিন মিজান
২৭ আগস্ট ২০২৩
এজি