সারাদেশ

‘আমি আর বাস চালামু না’

দুপুরে মেয়েকে যেখানটায় বাস পিষে দিয়ে গেছে, সেখানটায় বসে মেয়ের দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ছাতার অংশ বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। গত রবিবার রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় বাস পিষে মেরেছে যে দুই শিক্ষার্থীকে, তাদের একজন দিয়া খানম ওরফে মীমের বাবা জাহাঙ্গীর।

গতকাল সোমবার বাসায় গেলে জাহাঙ্গীর জানান, তিনি নিজেও বাসচালক। ২৭ বছর ধরে ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে বাস চালান। আজ পর্যন্ত তাঁর চালানো বাসের নিচে চাপা পড়ে কেউ মারা যায়নি। অথচ তাঁর মেয়েকেই কিনা বাসচালক পিষে মেরে ফেলল। অভিমান আর হাহাকার নিয়েই জাহাঙ্গীর বলছিলেন, ‘আমি আর বাস চালামু না। যেই বাস আমার মেয়েরে নিয়া গেল, সেই বাস আর ধরুম না আমি।’

বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত দুজনই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী। মীম ছাড়া আরেকজন হলো আবদুল করিম রাজীব। এক মাস আগে কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল দিয়া খানম মীম। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। নোয়াখালীর একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবদুল করিম রাজীব সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিল শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যাননমেন্ট কলেজে। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত সে। সড়কে প্রাণ যাওয়া দুই শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা মেনে নিতে পারছে না তাদের মৃত্যু। গতকালও তারা রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়। বিক্ষোভ হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে।

রবিবার রাতেই দুই শিক্ষার্থীর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত ১টার দিকে মীমকে দাফন করা হয়েছে তেজগাঁও এলাকায়। আর রাজীবের লাশ রাতেই নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। তার লাশ গতকাল দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

মীমের পরিবার রাজধানীর দক্ষিণ মহাখালীর জামে মসজিদ গলির জিপিক-৭৫ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকে। মীম ছাড়া আরেক মেয়ে রিয়া খানম ও ছেলে রিয়াদ, স্ত্রী রোকসানাকে নিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের পরিবার। গতকাল ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, স্বজন ও প্রতিবেশীরা গিয়ে মীমের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই সন্তানহারা মা-বাবার হাহাকার থামাতে যথেষ্ট নয়।

মেয়েকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন তার বাবা জাহাঙ্গীর, যিনি মেয়েকে অনেক বড় দেখতে চেয়েছিলেন। জানালেন, নিজে কষ্ট করে জীবন চালান, কিন্তু কোনো দিন মেয়েকে সেটা বুঝতে দিতেন না। তিনি চাইতেন মেয়ে অভাবের কথা জেনে যেন মন খারাপ না করে। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমার মেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তার হত্যার বিচার চাই।’

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে আমি মেয়েকে বাসে তুইলা দেই। রবিবার সকাল সাড়ে ৬টায় তাকে বাসে উঠিয়ে দিছিলাম। কিন্তু কে জানত সেদিনই আমি শেষবার আমার প্রিয় মেয়েকে বাসে উঠিয়ে দিচ্ছি।’ তিনি জানান, একতা পরিবহনের বাস চালান তিনি। রবিবার দুপুর ২টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল তাঁর। দুপুর পৌনে ১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় তিনি স্ত্রীকে বলে যান যে মীম বাসায় এলে যেন তাঁকে ফোনে জানানো হয়। কিছুদূর যাওয়ার পরই তাঁর ফোনে একটি কল আসে। তাঁকে জানানো হয়, মীমকে বাস চাপা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার হাত-পা ভেঙে আসে। কিভাবে সেখানে যামু ভাবতে পারছিলাম না। গিয়া দেখলাম আমার মেয়ে আর নাই।’

জাহাঙ্গীর আলম তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, ঢাকায় যারা বাস চালায় তাদের ঠিকমতো গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেই। বেশির ভাগই বাসচালকের সহকারী। তাঁর ভাষায়, ‘দুই দিন বাস চালাইয়া ড্রাইভার হইয়া গেছে। তো এরা মানুষ মারব না তো কী? এদের কোনো ঠিকানা নাই।’ তিনি বলছিলেন, ‘আমি সারা জীবন বাস চালাইছি, সেই ছোট থাইকা; কেউ আমার গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই। আমি তো কাউরে মারি নাই। তাইলে আমার মতো মানুষের মেয়ের কপাল এমন হইলো ক্যান?’

মীমের মা রোকসানা বেগম জানান, রবিবার সকালে বাসা থেকে যাওয়ার সময় মীম তাঁকে জানিয়ে যায়, দুপুর পৌনে ১টার দিকে বাসায় ফিরবে। কিন্তু তার আর বাসায় ফেরা হলো না। আহাজারি করে তিনি বলছিলেন, প্রতিদিনের মতো সেদিনও মেয়েকে নাশতা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নাশতা মেয়ে খেয়েছে কি না তা আর জানা হলো না তাঁর।

মীমের এক খালা জানান, মীম খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। সবাই ওকে পছন্দ করত। ঘরে বসে নিজে নিজে গান-বাজনা করত। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল।

অন্যদিকে রাজীবের বোন নাজমা বেগম কালের কণ্ঠকে জানান, সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মেধাবী রাজীব ভর্তি হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের এই কলেজে। তাঁদের বাবা নেই। ঢাকার আশকোনায় খালাতো ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করত সে।

Share