আমিরাতে দুই হাজার বছর

আমিরাতে দুই হাজার বছর কথাটা শুধু চিন্তার বিষয়ই নয়, পুরাদস্তুর অবাক করে দেওয়ার মতো একটি কথা। এটা কোনো গল্পকারের রূপকথা নয়, না কোনো ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, না কোনো অলৌকিককাহিনী।

এটি একটি বাস্তবচিত্র এবং যথার্থ সত্যঘটনা। আমিরাতে এসে জানতে পারি, প্রবাসীদের অন্তিমদশা! যারা নিম্নমানের চাকরি করছে তাদের অবস্থা ঘোরতর। যারা ছোটখাটো ব্যবসাবাণিজ্য করছে তাদের দশা করুণ, পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে; যেখান থেকে এক পা নড়াও সম্ভব না! যা রোজগার করছে, বছরশেষে মোটা অংকের সরকারি ফি–এ-ফি ও-ফি কর-ফি দিতে দিতে রীতিমতো জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে! এ অতিষ্ঠতায় কোনো কোম্পানি বা দোকানদার-ব্যবসায়ী রাগে দুঃখে অভিমানে অভিযোগে নীরবে-নিঃশ্চুপে চলে গেলে তাদের কর্মচারীগণ পড়তে হয়েছে বিপাকে। কারণ মালিক লাপাতা হলে মৌলিক অধিকার কার কাছে দাবি করে। জানা দরকার, এমন প্রবাসের চেয়ে বনবাস ভাল।

‘আমিরাতে দুই হাজার বছর’ কথাটার রহস্য পরে জানা যাবে। এখানে আমরা অনেকের কথা বাদ দিয়ে একজনমাত্র সহায়সম্বলহীনের কথা প্রচার করতে চাই, যে ছত্রিশ বছর বিদেশ খেটে নিঃস্বই রয়ে গেছে! ঊনিশ শ ছিয়াশি সালের কথা, সতের বছর বয়সের অতি গরিবপরিবারের এক নিরুপায় কিশোর সচ্ছল জীবনের আশায় জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে আমিরাত নামক দেশটিতে আগমন করে। কারণ অভাব মোচন করতে তখন বিদেশকেই অনেকে একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করছে। তাই স্বদেশ ও মা-বাবা ভাইবোনের মায়া ত্যাগ করে পরদেশকেই তারা আপন করে নিতে দেখা যাচ্ছে। তবে বিদেশ এসে অনেকেই যে অভাবমোচন করতে পারেনি বা পারছে না একথাও নয়। সকলের বিবেকবুদ্ধি যেমন এক হয় না তদ্রূপ সকলের ভাগ্যলিখনও একই কলমে লিখা হয় না। বিধাতা ’হও’ বললে সব হয়ে যায় কিন্তু সব ত আর একই ধাঁচে হয় না, তেমন মানুষের ভাগ্যলিপিও বোধহয় ভিন্ন ভিন্ন কলমে লিখা হয়? বিচারক ফাঁসি দেওয়ার পর যেমন কলমের নিপ ভেঙে ফেলে, কুল মখলুকাতের মালিক স্রষ্টাও বোধহয় এক-একজনের জীবনবৃতান্ত লিখার পর কলমটি ভেঙে ফেলে? নাহয় এক-এক মানুষের ভাগ্যকরোটি এক-এক রকম হয় কেন? যাই হোক, যেকথা আজীবন গোপন রয়েছে সেকথা আজীবন গোপনই থাক। যার কথা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু তার কথাই বলা হোক। যেই বয়সে একজন কিশোর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহল্লায় ও খেলাধুলায় মেতে দিন কাটার কথা সেই বয়সে তাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনি করে যুগের পর যুগ কাটাতে হয় পরদেশে! এটাই প্রায় প্রবাসীর নিয়তি।

জিন্দেগি খুব ছোট। কিন্তু জিন্দেগির আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বড়। একজন মানুষের জিন্দেগি শেষ হয়ে যায় তবু স্বপ্নদেখা বা ইচ্ছের শেষ হয় না। মানুষ আজীবন কামনার দাস, শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার কারাগারে বন্দি থাকতে দেখা যায়। তাই এ বালকও এমনই স্বপ্নের সুখপাখির শিকারে বাইর হয়েছিল একদিন। এ পাখির খুঁজে ছুটতে ছুটতে জীবনমাঠের শেষসীমায় চলে আসে তবু সেই পাখির দেখা মিলে না! তবু আশায় থাকে : আজ নাহয় কাল অথবা–দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর যায় তবু অপেক্ষায় থাকে সুখ নামক পাখিটির জন্যে–বহু বছর কেটে যায় কিন্তু কোথায় তার সেই সুখপাখি!

এর মধ্যে খবর আসে, বাবা মরে গেল! তখন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লেও মায়ের সান্ত্বনাই ছিল পথচলার প্রেরণা। আরেকদিন চিঠি এল, মা নেই! তখন আশার আলো নিবে চার দিকে দেখে আঁধার আর আঁধার। নিরুপায় যুবক–ভিসা নামক শিশা ভেঙে কবেই চুরমার হয়ে গেছে জানা নেই। চুপিসারে কাজকর্ম করে চলছে এখানে-ওখানে। এক দিন করতে পারলে তিন দিন বসে খেতে হয়। বাড়ি যাওয়ার কথা একবার ভাবলে তিনবার মনের বাধা আসে, কারণ চিরনিষিদ্ধের লালকালির মোহরের ভয়। পুনরায় আসতে পারলে নাহয় কোনো একটা সদগতি হত। বাড়ি গিয়ে করবে কী, এটাও চিন্তার বিষয়। এতটুকু জমিজমা অবশিষ্ট রাখেনি যে, তা বিক্রি করে কিছু একটা করবে। সম্বল বলতে সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। সব সময় লেগে থাকে আইনের হাতে ধরা পড়ার ভয়। অবৈধ প্রবাসীদের মন ফাঁসির দণ্ড আসামির মনের চেয়েও অস্থির। ধরা পড়ে দেশফেরত হলে কেউ কেউ মৃত্যুকামনা করে এবং কেউ কেউ লজ্জার চেয়ে মরণ ভাল মনে করে।

আমরা বলছি না, দুনিয়ার সকল অবৈধ প্রবাসীদের বৈধতা দাও। আমরা এটুকু কামনা করছি, তাদের একটা সদগতি হোক। কারণ অনেকে বিদেশ এসে হাজার কোটি টাকার মালিক না হলেও কোটিপতি ত বনেছে–এটা অবশ্য বাস্তব। তাদের অনেকেই আশেপাশের গরিবিদূরিকরণে যে দানদাক্ষিণ্যের হাত বাড়ায়নি একথাও অবাস্তব নয়। গরিবিকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছে তারা তার চেহারা কখনো ভুলতে পারবে না। তাই যেখানেই তারা গরিবির ছায়া দেখবে সেখানেই তাদের সবল হাতের ছাপ আশা করা যাবে।

গ্লাফের যে আইনকানুন আমরা দেখছি সাধারণত তা অন্যসব দেশে দেখা যায় না। এখানে ভিনদেশিরা ব্যবসাবাণিজ্য করতে গেলে (স্পন্সর) কফিল। অন্য কোথাও চাকরি করতে গেলে বাধা। আইনের হাতে ধরা পড়লে জেলজরিমানাপর চিরনিষিদ্ধ! এ কেমন বিচার? এমন বিচার কি মানবতার কাতারে সামিল হতে পারে? একটি নগণ্য অপরাধে যদি জেলজরিমানাপরও আজীবন নিষিদ্ধ হতে হয়, তা হলে এসব দেশে শ্রম দেওয়ার যৌক্তিকতা কী? নিজের দেশে খেটে খাওয়া অনেক ভাল। কারণ যে গাছটি ছায়া দিতে অক্ষম তার তলে আশ্রয় নেওয়া বোকামি। এবং প্রাচুর্যের মোহে যে দরদানুভূতি ভুলে যায় তার কাছে সহানুভূতির প্রত্যাশা করা ভুল। গ্লাফের আলোবাতাস কারও জন্যে নয় সকল প্রবাসীদের জন্যেও যদি নিষিদ্ধ হয়, আশা করি বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না কোনো প্রবাসীর জীবনে। তা হলে? মানুষ দিন দিন গ্লাফের প্রতি যেহারে বিমুখ হচ্ছে, একদিন গ্লাফ নামের কোনো শব্দ মানুষের অন্তরে থাকবে বলে মনে হয় না! কারণ অমৃত মনে করে বারবার বিষফল খাওয়া যায় না।

ভিনদেশিদের প্রতি যে আচরণ ‘তারা’ স্বদেশিরা করে! এ আচরণ কিন্তু মনুষ্যত্বের আচরণ নয়। এ আচরণ বর্বরতার পরিচয়। আল্লাহ্‌র কাছেও ফেরেস্তার চেয়ে মানুষের মর্যাদা বড়। আর তাদের কাছে দরিদ্রদেশের শ্রমিকেরা মানুষই নয়! শত্রু শত্রুর প্রতি বিমুখ হয় তবে এমন আচরণ কেউ করে বলে মনে হয় না। মানুষ মানুষকে ভালবাসা মনুষ্যত্বের পরিচয়। যারা মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে অক্ষম তারা ঘৃণিত। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ভিনদেশি নেই। যারা পরকে আশ্রয় দেয়, পরের স্বার্থের কথা ভাবে তারা সবচেয়ে মহান এবং হৃদয়বান। তবে আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভিখারিকে ভিক্ষা দেখিয়ে তার ভাণ্ড কেড়ে নেওয়ার কূটকৌশল।

আজ গ্লাফজুড়ে দেখা যাচ্ছে, ভিসাব্যবসা একটা অন্যতম ব্যবসায় পরিণত হয়েছে! সরকার যেখানে সামান্য একটা কাগজের বিনিময়ে হাজার হাজার টাকা কেড়ে নিতে একবিন্দু সংঙ্কোচ করছে না, সেখানে সাধারণ মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতে দ্বিধাবোধ করবে কেন! সামান্য একটা কাগজের মূল্য যদি এত হয়, তা হলে হিরামুক্তা ও সোনাচাঁদির মূল্য তত বেশি অস্বাভাবিক মনে হয় না। মজলুমের প্রতি জুলম করা যদি অন্যায় হয়, তবে এটা কেমন ন্যায়? এটা কি মজলুমদের প্রতি অত্যাচার নয়? শক্তি যার আছে সে দুর্বলকে লাথি দিতে একটুও চিন্তা করবে না–কেন? এবং সবলের সঙ্গ দিতে এতটুকুন বিবেকতাড়িত হবে না? এটাই যদি দুনিয়ার দস্তুর হয়! এবং এটাই যদি মানুষের নীতি হয়! তা হলে এ নীতির কাছে একজন দুর্বল কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, আর তখন তাকে বাধ্য হয়ে অন্যপথ অবলম্বন করতে হবে।

মনে রাখা দরকার, নতুন মানুষের চেয়ে একজন পুরাতন মানুষ সব সময় কার্যকর এবং অগ্রসর ও অভিজ্ঞ। যে কথাটা একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞই বলতে পারে। মানুষ মনুষের প্রতি বিমুখ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু এমন নির্দয় হতে পারে না। এখানে ভিনদেশিরা অপরাধ করে। তবে অন্য জায়গায় শ্রম দেওয়া এমন বড় অপরাধ কি যে? যার জন্যে একজন শ্রমিক-ব্যবসায়ীকে গ্লাফের আলোবাতাস চিরনিষিদ্ধ করে ফাঁসির মতো দণ্ড প্রদান করতে হবে! কেননা এটা একজন শ্রমিক-ব্যবসায়ীর জন্যে ফাঁসির দণ্ডই বটে। কারণ আমরা এমন কতজনকে দেখেছি, এ দণ্ডের কারণে তার লক্ষ টাকার (রিয়াল বা দিরহাম) লেনদেন রেখে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়েছে! আজকাল খুনি আসামীর প্রতিও সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে, হয়তো কোনেক পরিস্থিতির শিকার সে। মানুষ কখনো স্বেচ্ছায় অপরাধ করে না–হয়ে যায়। তাই অপরাধীর অপরাধানুসারে দণ্ডিত করা প্রত্যেক বিচারকের কর্তব্য। বিচারকগণ মনে রাখতে হবে, তাদের এ আদালত শেষ আদালত নয় তার উপর আরেকটি মহা আদালত আছে এবং আরেকজন মহাবিচারক আছে আর সে বিচারকের আদালতের কার্যক্রম এতই নিখুঁত যে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও খুঁত পাওয়া যাবে না। একথা যেন দুনিয়ার বিচারকগণ মনে রাখে, অই আদালতের কাঠগড়া সকলের জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমরা এমন কথা কখনো বলব না যে, সকলে নিরাপরাধী এবং নিতান্ত ভাল মানুষ। সকলেরই কিছু-না-কিছু অপরাধ থাকে। তবে চুরিডাকাতি, খুনখারাবি, রাহাজানি, জোরজুলুম, অত্যাচার ও ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ মানি। কিন্তু একস্থানের ভিসায় অন্যস্থানে শ্রম দেওয়া কোন্‌ ধরনের জঘন্য অপরাধ আমাদের বুদ্ধির অতীত! যদি তা জঘন্য অপরাধই হয়, তা হলে হত্যা কী ধরনের অপরাধ? যার জন্যে একজন মানুষকে আজীবন নিষেধাজ্ঞার গ্লানি বহন করতে হয়! এজন্যে মনে করি, সকল দূতাবাসকে সোচ্চার হতে হবে, আলোচনা করতে হবে নিজ নিজ শ্রমিকদের ন্যায্যাধিকার নিয়ে। মনে রাখতে হবে, স্বীয় জনস্বার্থ যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে কোনো অধিষ্ঠান কল্যাণকর নয়। ভিক্ষুকের জন্যে এক দুয়ার বন্ধ হলে কিছু যায়-আসে না–সে অন্যদ্বারের আশা রাখে। তবে সকল দুয়ার বন্ধ হলে ভিক্ষুকের গতি কী? একি ন্যায়? একটি ভুলকদমে যদি সকল দুয়ার বন্ধ হয় তা হলে ভিখারির পেট পুরে কিসে? এ কেমন কানুন? এক দেশের অপরাধে বহু দেশ নিষিদ্ধ! এক অপরাধে যেমন দশবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না তদ্রূপ এক অপরাধে দশ দেশ সাজা দিতে পারে কি? মানুষকে ভালবাসা প্রিয় নবি মুহাম্মদ (স.)এর ধর্ম। মানুষ ও মনুষ্যত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ তিনি। মানবজাতির কাছে কোনো অধিকার চাননি তিনি তবু পেয়েছেন দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছনা! কিন্তু প্রভু করেছেন তাঁকে সকল সম্মানের অধিকারী। তাঁর কারণে আরবিরা সম্মানী–আরবজাতি অগ্রগণ্য। আরবের মাটি আজ সোনার চেয়ে দামি। কিন্তু পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মধ্যমরা মানবতার কত নিচে! পশ্চিমেরা এক দেশের অপরাধীকে কিন্তু আরেক দেশ আশ্রয় দেয়, সাজা দেয় না। তাই সেই আবহমানকাল হতে শোনা যাচ্ছে মানুষ পশ্চিমের গুণগ্রাহী। আজও দেখা যাচ্ছে সেই ধারাবাহিকতা জারি রয়েছে। টাকার পাহাড়ের বিনিময়ে মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু, ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিনামূল্যেও মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে আসতে নারাজ! সেই একটা সময় ছিল দুবাইয়ের নাম শুনলে অনেকে আশ্চর্য অনুভব করত। আজকাল দেখা যাচ্ছে তার নামোচ্চারণেও যেকেউ অবজ্ঞা প্রকাশ করছে! এটা বৃহত্তর নামি অথবা ধনী একটি রাষ্ট্রের জন্যে কম লজ্জার বিষয় নয়। দুর্ভাগ্য এমন দেশের, যারা মানুষের আশ্রয়স্থল তৈরির মাধ্যমে সুনাম অর্জন করতে পারে না। দুর্ভাগ্য এমন ধনীদের, যারা অসহায়দের জন্যে এতটুকু সহায়তা করতে পারে না। ভাল বাড়িতে বাস করে, ভাল কাপড় পরে এবং ভাল নামিদামি গাড়ি দৌড়ালে ভাল মানুষ হওয়া যায় না। ছেঁড়া কাপড় পরে, মাটিতে বাস করে মানুষকে ভালবেসে মানুষের সুখদুঃখের ভাগিদার হতে পারলেই ভাল মানুষ হওয়া যায়। যেমন মানুষ সাধকপুরুষগণ হয়েছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যের আইনকানুনের নিয়মনীতির দুর্নাম করা যায় না। তবে এ আইনকানুনের নীতিমালা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আজনবিদের পাবন্ধিতে তৈরি, যা পরোক্ষভাবে বোঝানো বোধহয় কোনো প্রবন্ধকারের পক্ষে সম্ভব না। প্রায়ই একটার চেয়ে একটা কঠিন করে করে নতুন নতুন আইনের ধারা তৈরি করা হচ্ছে কেবল ভিনদেশিদের উদ্দেশ্যে। আর এ নিয়মকানুনের দৃঢ়তার ঘেরাওতে আবদ্ধ হতে হতে ভিনদেশিদের অবস্থিতি এতই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তারা ফাঁসির কারাবাস অনুভব করতে হচ্ছে! কোনো সুযোগসুবিধা গ্লাফপ্রবাসীদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। আগে-পিছে-ডানে-বামে যেদিকে তাকায়না কেন, শূন্য ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু প্রবাসীরা আশার মশাল জ্বেলে প্রতিনিয়ত পথ চলছে। আর এটা সকলের জানা আছে, এ মশাল যেকোনো সময় খপ করে নিবে যেতেও পারে–তার গ্যারান্টি আছে। বড়ই দুঃখের কথা, আমরা এমন কতক মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসীর কথা শুনেছি এবং সসাক্ষাতে দেখেছি, শেষসম্বল ভিটেবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে সচ্ছল জীবনের আশায় উপসাগর পাড়ি দিয়েছে আর এসব আশাবাদীদের সচ্ছল জীবন পাওয়া ত দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত অর্জিত প্রাপ্যও পাওয়া হয়নি! কারণ অনেকে অনেক জায়গায় বৈধভাবেও চাকরি করে প্রতারিত হতে হয়েছে এবং হচ্ছে! মাসের পর মাস শ্রম দিয়েও কানাকড়ি পাচ্ছে না! অনেক কোম্পানি দেনার দায়ে কিবা আইনের বেড়াজালে আটকে চুপিসারে বাগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে! এসব কোম্পানির শ্রমিকেরা অনেকে অনেক দৌড়ঝাপ করেও বৈধতা হাসিল করতে পারছে না! অনেকে কোম্পানির জন্যে মামলা ঠুকেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এমন ঝটঝামেলার লোকেরা বাধ্য হয়ে অবৈধ হতে হচ্ছে, সংসারের পীড়ায় ও পেটের দায়ে অন্যত্র কাজ জুটিয়ে নিতে হচ্ছে। এ অপরাধ কি জঘন্য হতে পারে? যার ফলে এসব অসহায় শ্রমিকেরা চিরনিষিদ্ধের রক্তসীলে দেশফেরত হতে হচ্ছে!

একটা সত্যকথা বলি? আমরা হুজুকে পথ চলি। নাটকে চরিত্রের ফাঁসি হলে আন্দোলন করতে পারি! কিন্তু বহুতল ভবন থেকে ছিটকে পড়ে শ্রমিক মরলে তার জন্যে উহু শব্দও করতে পারি না! কারণ সে ত আমার আপনজন কেউ না, বেনামি একজন শ্রমিক মাত্র। আমার গরজ কি তার জন্যে আফসোস করা? আমি কেন এমন অপরিচিত কারও জন্যে দরদ দেখাব? এখানে মনুষ্যত্বের খর্বতা। এটাই মানুষ-অমানুষের তফাৎ। বড় কেউ হুঁ করলে ভুঁ হয়ে যায় আর গরিব ডুবে মরলেও চোখ তুলে কেউ না চায়! এ পৃথিবী কি তা হলে গরিবদের বাসস্থান নয়? গরিব ডুবে মরে ত মরুক তাতে আমার কি, আমি তেতলায় সুখের ঘুমে ঘুমাতে পারলেই হয়! এ পৃথিবীতে বোধহয় তারাই মানুষ হতে পারে? যারা পিছনে লাথি মেরে সামনে দাঁড়াতে পারে হাতজোড়ে।

এই ত সেদিনের কথা, বাংলাদেশ যখন জলোচ্ছ্বাসে ভাসছে; এদিকে আমিরাত ঘোষণা করল, অবৈধ প্রবাসীদেরকে দেশফেরত হওয়ার সাধারণ ক্ষমা। বাংলাদেশ প্লাবনে সমুদ্র হোক অথবা কাঠফাটা রোদে সাহারা মরুভূমি তাতে কারও কিছু যায়-আসে না। আর কারও দরকারইবা কী অন্যের জন্যে মাথা ঘামানোর! আজকাল পাড়াপ্রতিবেশিও পাড়াপ্রতিবেশির জন্যে দরদ দেখায় না, সেখানে সুদূর একটি দেশ আরেকটি দেশের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়াবে কোন্‌‌ উদ্দেশ্যে! হাঁ, তবে মানবতার কথা বলা যায় এবং মমত্ববোধের কথা বলা যায়। কিন্তু তা দিয়ে নিষ্ফল কামনা ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। তবে একটি দেশ যতই ক্ষুদ্র হোক, কখনো আরেকটি দেশের মুখাপেক্ষী হয় না। কারণ, তার ক্ষুদ্রতায় দীনতায় সে সব সময় ধন্য।

ধুলোবালি আর পাতার ঘরে যেই সুখ, প্রাচুর্যের বিলাসভূমিতে বোধহয় সেই সুখ নেই? কারণ শৌখিনতায় দুঃখের চেহারা স্পষ্ট দেখা না গেলেও সুখের চেহারা যে বড়বেশি পরিষ্কার দেখা যায় সেটা বলা মুশকিল। কথায় আছে, বেশি সুখ কপালে সয় না। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই না, সুখের মোহে যারা অতীতের দুঃখের কথা ভুলে যায় তারাই একদিন বড়বেশি দুঃখ ভোগ করে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সুখের সঙ্গে দুঃখের বড়বেশি সখ্যতা। তাই অসহায়দের কথা বিবেচনা করা সম্পদশালীদের কর্তব্যই নয়–দায়িত্বই বটে।

পৃথিবীর যেসকল দারিদ্র্যদেশ থেকে দরিদ্র শ্রমিকেরা এসে এসব মরুভুমিকে আজ স্বপ্নভূমিতে পরিণত করছে, তারা কতটুকু স্বপ্নোত্তীর্ণ হতে পারছে? বিনিময়ে অর্থ যে ওরা পায়নি বা পাচ্ছে না এমন কথা নয়, অর্থ আর অধিকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। যেমন পার্থক্য দয়া আর দেনার মধ্যে। ভাবলে অবাক লাগে, যারা রক্ত পানি করে–মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসব দেশকে শ্রম দিয়ে, মেহনত দিয়ে–রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, টওয়ার-ইমারত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় বড় সূচ্চভবন নির্মাণ করে গেছে এবং করে যাচ্ছে তারা কী পেয়েছে বা পাচ্ছে, দুঃখবঞ্চনা হাহাকার ছাড়া? কী অধিকার মিলেছে তাদের? তুচ্ছ অপরাধে মৃত্যুর সমান আজীবন নিষেধাজ্ঞার শাস্তি ছাড়া! কী পেয়েছে এসব শ্রমিকেরা? সামান্য অর্থ, যা দিয়ে না তার ভাল জীবন গঠন করতে পারছে, না তার পরিবারের। অস্ত্রের আঘাতে বা গলাটিপে হত্যা করাকে শুধু হত্যা বলা হয় না, চক্রান্তে ফেলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করাকেও হত্যা বলতে হয়।

এবার আমিরাতে দুই হাজার বছরের তাৎপর্যটা একটু বলি, সতের বছর বয়সের একজন কিশোর ছত্রিশ বছর বিদেশ খাটার পর সে আর কিশোর রয় না; হয়তোবা রোগাক্রান্ত মৃত্যুর পথপথিক, না হয়তোবা লাঠি-আশ্রিত বাঁকাদেহী পুরোপুরি বৃদ্ধ একজন।

ঊনিশ শ নিরানব্বই সালের কথা, বহু কষ্টের সুদির্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা প্লাটফর্মে উপনীত হয় সে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা করছে। চরম উন্নতির দেখা না পেলেও ভালই কাটছে দিন। কিন্তু, একথা কি কখনো অস্বীকার করা যায়? সুখের দুয়ারে সব সময় অশুভছায়া এসে দাঁড়ায়! তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় পড়ল মহাবিপদে। ভিসার কী সমস্যা সমাধান করে কেটে উঠতে পারছে না। দেশফেরত হতে বাধ্য। তাকে উদ্ধার করতে হবে। তার দোকানটার ভার নিতে হবে। নিল। পাঁচ-কি-ছয় মাস থালা ঝুলে রাখার পর সময় এল দোকানটা খোলার এবং আত্মীয়কে ভিসা দেওয়ার। মাঝে মাঝে একাজে-ওকাজে দোকনটা খুলছে, কিছু কিছু সময় বসে জরুরি কাজকর্ম সারছে। কিন্তু, ইতোমধ্যে একটা আইন জারি হয়েছে, যেকেউ অন্যত্র কাজ করতে পারবে তবে (মিনিস্ট্রী অফ ইন্টিরিয়র) লেবারকোর্ট থেকে ছয় মাসের ছাড়পত্র নিতে হবে। সেই আইনানুযায়ী ছয় মাসের ছাড়পত্র নেওয়া হল তার। তবে ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ-তারিখানুযায়ী সেই ছাড়পত্রটি তাকে প্রদান করা হয়েছে চার মাসের জন্যে। এটা যুক্তিযুক্ত বটে। তবে পুনরায় নবায়ন করতে হলে আগে ভিসা নবায়ন করা জরুরি।

এবার এল ভিসা ধারণের সেই কান্নাপল! কান্নাপল এজন্যে যে, চোখের পলকে বর্তমানে গ্লাফপ্রবাসীদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ভিসার মেয়াদ দুয়েক বছরের বেশি কোথাও দেখা যাচ্ছে না। যাই হোক, এটাই যখন একটি দেশের আইন, এ আইন অমান্য করা কিছুতেই চলবে না এবং মেনে চলাই কর্তব্য। যতই কষ্ট হোক, টাকার পাহাড় লাগুক একাজের সমাধা করতে হবে, নাহলে লাঞ্ছনার অবশিষ্ট থাকবে না। তাই যেভাবেই হোক ভিসার মেয়াদ সচল রাখা চাই।

ইদানীং তার ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ। তাই বেশির ভাগ সময় দোকানটা বন্ধ রাখা হয়। আজ কী জন্যে–হয়তো ভাগ্যবিড়ম্বনায় দির্ঘক্ষণ এসে বসল দোকানখুলে। এমন সময় কয়েকজন লেবারকোর্ট-অফিসার এসে হাজির, কাজের অনুমতিপত্র চায় অর্থাৎ ওয়ার্ক পারমিট। ছাড়পত্রটা ওঁদের হাতে দেওয়া হল। একজন অফিসার ভাল করে দেখে সঙ্গিদের আরেকজনকে ডেকে বলছে, দেখ দেখ–এটার মেয়াদ শেষ হয়েছে কবে–প্রায় মাস ছুঁই ছুঁই! হয়ে গেল ফাঁসির দণ্ডীয়মান অপরাধ। অপরাধী বিমর্ষ–ভয়ে কেঁপে কেঁপে বলল, স্যার, আরেকটা কাগজ তৈরি আছে অনুগ্রহপূর্বক একটু দেখুন। অফিসারগণ দেখল, এ কাগজটাও ছাড়পত্র বটে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন্‌ করা হয়নি। অফিসারজন বলল, একি? পরিহাস করার জায়গা এটা নয় জনাব!

অপরাধী হাতজোড় করে বলল, স্যার, সাম্মিট করতে পারিনি, কারণ আমার পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ শেষ–নবায়ন না করে এটা জমা করা যাচ্ছে না। অফিসারজন বলল, সেই দেখা যাবে–চল…

শুরু হল অন্ধকার জীবনের অবাঞ্ছিত অধ্যায়। সপ্তাখানেক হাজতবাসের পর কারাবাস। সেই জ্বালাময়ী দিনগুলোর কথা বললাম না আর। শুধু এটুকু বললাম, এক-একটি পল যেন কেটেছে তার এক-একটি মাসের মতো! এক-একটি মাস যেন কেটেছে তার এক-একটি শতাব্দীর মতো!

এধরণের নগণ্য অপরাধের জন্যে যদি কোনো প্রবাসী জঘন্য অপরাধের কারাভোগ করতে হয়, তা হলে এমন দেশের সচ্ছলতার চেয়ে নিজদেশের দীনতা অনেক ভাল। যেমন, জিল্লতির সুখাদ্য থেকে সম্মানের নুন্‌‌ভাত উত্তম। আগেও বলেছি, এখানে সমস্ত পাবন্দি এবং আইনকানুন কিন্তু ভিনদেশিদের জন্যে। স্বদেশিরা ইচ্ছে করলে রাতকে দিন–দিনকে রাত বানাতে পারে। তাদের জন্যে আইন কি আর কানুন কি। যারা লোক্যাল তাদের অনেক কিছু মাফ বলা যায়! বলা বাহুল্য, একজন অতিথির প্রতি আতিথ্য করা যেমন গৃহস্থের কর্তব্য, বিদেশিদের প্রতি তেমন উত্তম আচরণ করা কি একটি রাষ্ট্রের কর্তব্য নয়?

আইন! আইন!! আইন!!! প্রতিনিয়ত আইনের এ নতুন নতুন ধারা এবং মহা হুঙ্কার কেবল ভিনদেশিদের কানের পর্দা ছেঁদন করছে না, তাদের ভয়াতঙ্কে দিন কাটতেও বাধ্য করছে; কারণ, কখন কী আইন হয়ে বসে! সকালে ঘুম থেকে উঠে কখন যে দেখতে হয় আজনবিদের দুনিয়াটা অন্ধকার, লাখ লাখ টাকার ব্যবসাবাণিজ্য রেখে চলে যেতে হচ্ছে খালি হাতে! ব্যবসায়ীরা এত বেশি কর দিয়েও কোনো সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারছে না! কারণ এসব দেশে কোনো ব্যবসাবাণিজ্য ভিনদেশির নামে হতে পারে না, অতএব নেই বলা যায়। তবে এখানে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ভিনদেশি। তাই করের বোঝা বইতে বইতে ছোটখাটো দোকানদারেরা–ব্যবসায়ীরা মরেই যাচ্ছে। কারণ অনুন্নত কোনো দেশের মতো কর ফাঁকি দিতে পারলে বাঁচামরার কোনো কথায় আসত না। এসব দেশে লক্ষ-হাজার টাকা ত দূরের কথা, সিকি-আধুলিপরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং কর আদায় করা যায় এবং প্রত্যেক নাগরিক থেকে আদায় করা যায় কিন্তু ভিখারির ভাণ্ড থেকে আদায় করা যায় না। তদ্রূপ কিছু কিছু ছোটখাটো ব্যবসাকে করের অতিরিক্ত বোঝা চাপাতে নেই, কারণ কোনো কোনো ব্যবসায় অতিরিক্ত লাভ করা দূরে থাক, সীমিত লাভও দুরূহ ব্যাপার। এসমস্ত দোকানিরা বছরশেষে কান্নাকাটি জোড়তে হয়, মোটা অঙ্কের ফি মিটাতে সব সময় ঋণ করতে হয়। এসব ঋণ শেষ হতে-না-হতে আবার ঘুরে আসে বছর! একবিন্দু স্বস্তির নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারে না করপীড়িত প্রবাসীরা। তবে স্বদেশিরা মনে করে, টাকার পাহাড় নিয়ে যাচ্ছে প্রবাসীরা। কিন্তু তারা এতটুকু চিন্তা করছে না যে, ভিনদেশি ছাড়া এবং ভিনদেশিদের শ্রম ছাড়া এসব দেশ কীভাবে ডেভেলাপ করা সম্ভব হত? তবু ভিনদেশিরাই অপদার্থ! কারণ, দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। এভাবে চলছে গ্লাফপ্রবাসীদের করুণজীবন।

লেখক : আযাহা সুলতান 

|| আপডেট: ১২:২০ এএম,২৪ অক্টোবর ২০১৫, শনিবার

 এমআরআর

Share