জাতীয়

আমরা অসাধারণ এক নেতৃত্ব পেয়েছিলাম : ড. কামাল

ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি পাকিস্তানের হরিপুর জেলে ছিলাম। ওই সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে। বিজয়ের মাসে মুক্তি পাওয়ার আগে জেলে তার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের ব্যবহারের উন্নতি ঘটে।’

তিনি বলেন, ‘আমি বললাম ব্যাপারটা কী? আগে একটা টিনের বাটিতে একটু ডাল আর একটা রুটি দিয়ে যেত, এভাবেই চলেছে এই নয় মাস। ১৬ ডিসেম্বর থেকে তিন পদ খাওয়া। তো ওরা বলল- না না, ডাক্তার বলেছে তোমাকে ভালোমতো ডায়েট দিতে। তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, বাইরে কিছু ঘটেছে।

তো তারপর আমাকে বলল যে, আপনি একটু পরিদর্শন করেন জেলে। সুপারিনটেন্ডেন্ট এসে জেলের তালা খুলে আমাকে সারা জেলে ঘোরাচ্ছেন। এই আমাদের কারখানা, এই আমাদের অমুক ইত্যাদি। তো আমিও হাসতে হাসতে বলেছি, নয় মাস পরে তো এটা ভালোই লাগছে।

তারা বলল- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমরা তো এখানে আস। আর বাইরে গিয়ে তোমরা ভিআইপি হয়ে যাও। আমি তখনই বুঝতে পেরেছি যে, ভিআইপি হওয়ার মানেটা কী। এরপর দীর্ঘ গল্প। ওই সময় আরেকটি জেলে নেয়া হল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হল, কথা হল।’

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সম্প্রতি সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন ড. কামাল হোসেন। দীর্ঘ আলাপে নিজের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্বীকার করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘রাজনীতিতে একদম প্লান করে আসা হয়নি। ১৯৬০-৬১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হল।

উনার জামিনের জন্য সরোজি সাহেব গেছেন। আমি পেছনে পেছনে গিয়েছি। মানিক মিয়া সাহেবের বাসায় উনার (বঙ্গবন্ধুর) আইনজীবী থাকতেন, আমিও যেতাম। তো উনার সঙ্গেই কথা বলে জানতে চাইলাম- মার্শাল ল’ কতদিন চলবে? উনি বললেন পাঁচ বছর, খুব বেশি হলে দশ বছর। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।

’৬৯ সালে আইয়ুব খান বিদায় নিল, তখন আমি উনাকে বলেছি যে, আপনি কিভাবে অঙ্ক করলেন? ঠিক আপনার কথা মিলে গেল। জবাবে তিনি হাসলেন। তার এই অসাধারণত্ব আমি খেয়াল করেছি। আমি মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।’

ড. কামাল হোসেন। খ্যাতিমান আইনজীবী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার পরিচিতি ব্যাপক। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এই প্রধান দুই কাজের বাইরে মানবাধিকার নিয়েও উচ্চকিত ছিলেন বরাবরই।

জাতিসংঘের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেছেন আফগানিস্তানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশে প্রতিবেশী পাকিস্তান তালেবানদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করত, এ বিষয়টি ড. কামাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে আনেন নিজের রিপোর্টে। ১৯৯৮ সালে স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে তিনি সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন।

একান্ত আলাপে ড. কামাল বলেন, আরেকটি জেলে দেখা হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বললেন- এত দেরি হল কেন? আমি বললাম যে, এই ব্যাগে তো আর কিছু ছিল না। আমাকে বলার পর আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গেছি। ওরা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসেছি। ওখান থেকে আসতে অবশ্য দুই/আড়াই ঘণ্টা লেগেছে।

তখন উনিই বলতে লাগলেন যে, ২৬ তারিখে তো আমি এখানে। তার মানে ২৬ তারিখ বা তার কাছাকাছি সময়ে মিয়াওয়ালি জেল থেকে উনাকে এখানে আনা হয়েছে। নতুন ওই জায়গাটার নাম ছিল শিহালা গেস্ট হাউস। এটা পুলিশ একাডেমির একটা অতিথি ভবন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে দু’দিন আগে।

আমাকে আনার পরেই দেখি ঢুকছে ভুট্টো। তো আমি ভুট্টোকে বলি তুমিও কি বন্দি হিসেবে এসেছ। তো সে বলল না না, আমি তো প্রেসিডেন্ট।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি ভুট্টোকে প্রশ্ন করি যে, ‘তুমি কি করে প্রেসিডেন্ট হলে? আমি তো ১৬৭ সিট পেলাম। তুমিতো তার অর্ধেকের চেয়েও কম পেলে।’

তখন ভুট্টো বললেন যে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনিই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।’ তো উনি বললেন যে, ‘রাখো এসব আমিতো রসিকতা করছিলাম। আমি যত দ্রুত বাংলাদেশ যেতে পারি সেটার ব্যবস্থা করো।’ তখন ভুট্টো বললেন যে, আমাকে ‘দু/চার দিন সময় দেন, আমি অবশ্যই এটা করব।’

তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমার ধারণা কামাল হোসেনও এখানে কোথাও বন্দি আছে। ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে, ‘ভুট্টো তো কথা রেখেছেন। পরশু ভুট্টোকে বলার পর আজ তোমাকে এখানে এনেছে।’ ওখানে আমরা ১০ দিন থাকলাম। এরপর একসঙ্গে দেশে ফিরলাম ।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরছিলেন, লন্ডন বিমানবন্দরে তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সম্মান জানানো হয়েছিল। ব্রিটেনের পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়ে বলেছিল, ‘আপনার জন্য আমরা প্রার্থনা করেছিলাম।’ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে প্রথমে লন্ডন, এরপর দিল্লি হয়ে দেশে ফেরেন।

সেদিনের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘এটা বিশেষ দিন। একসঙ্গে আমরা ফিরে এসেছি। আমার জন্য দিনটা আনন্দের।’ তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা অসাধারণ এক নেতৃত্ব পেয়েছিলাম। সেই নেতৃত্বের কারণেই আমাদের স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, বঙ্গবন্ধুকে সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

তবে দুঃখ লাগে, অন্যান্য দেশের জাতির পিতা ২০-৩০ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে থাকেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে উনাকে খুব কম সময়ের মধ্যে হারিয়েছি। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল উনাকে বাঁচিয়ে না রাখতে পারা। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর মধ্য দিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতি আমরা আর কাটিয়ে উঠতে পারব না।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের ব্যাপারে আপস কখনও করেননি। কোনো অন্যায় দেখলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। স্বাধীনতা মানে সব জনগণের, কোনো ব্যক্তির না। এখানে স্বৈরতন্ত্র থাকার কোনো অবকাশ নেই। নির্ভেজাল গণতন্ত্র থাকবে- এটাই মনে করতেন বঙ্গবন্ধু।’

ঢাকা ব্যুরো চীফ,১৭ মার্চ ২০২০

Share