প্রয়াত বাম নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য চাঁদপুরের কৃতি সন্তান আবদুল্লাহ সরকারকে নিয়ে একটি বই বেরিয়েছে—‘৭৩ এর সংসদ ও একজন আবদুল্লাহ সরকার ’। নামেই স্পষ্ট যে এটি সংসদে দেয়া তার ভাষণের কপি।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সংসদে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯১টি আসন লাভ করে।
মোজাফ্ফর ন্যাপ ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি, জাসদ ১টি ও নির্দলীয় ৫ সদস্য নির্বাচিত হন। একটিতে স্থগিত হয়। বিরোধী আসনে মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন আতাউর রহমান খান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, স্বতন্ত্র সদস্য আবদুল্লাহ সরকার, ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালাউদ্দিন প্রমুখ।
১৯৭৩ সালের আগেও কিন্তু আমাদের আরেকটি সংসদ ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান এবং পাকিস্তানের একটা বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুসারে তাকে লন্ডন পাঠানো হয়। লন্ডন থেকে তিনি দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে সরকারের পুনর্বিন্যাস করেন। বঙ্গবন্ধু ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রী, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী এবং প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও কামারুজ্জামানকেও মন্ত্রী করা হয়।
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয় এবং ২৬ মার্চ তা কার্যকর হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ অংশ থেকে থেকে ১৬৯ জন জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের জন্য ৩০০ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বমোট ৪৬৯ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদের পাঁচজনের মৃত্যু হয়, পাকিস্তানের দালালির জন্য ২৩ জনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। নুরুল আমিন এবং রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে চলে যান। অবশিষ্টরা গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকেন। আব্দুল হামিদ গণপরিষদের স্পিকার ছিলেন আর মোহাম্মদ উল্লাহ ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। বলা যায়, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালে পর্যন্ত গণপরিষদ বাংলাদেশের অস্থায়ী সংসদ হিসেবে ছিল। এ গণপরিষদে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়, যেটি প্রণয়ন করেছে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের সংসদীয় কমিটি।
প্রথম সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খান। তিনি আওয়ামী লীগের গঠন পর্যায়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য এবং খ্যাতিমান আইনজীবী। বঙ্গবন্ধু নিজেই তাকে লিডার বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দলীয় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং সে সময় তিনি দু’বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ’৭৩-এর পার্লামেন্টকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। আবদুল্লাহ সরকার, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা কমবয়সী পার্লামেন্ট সদস্য হলেও কোনও সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। সুযোগ পেলেই তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরতেন।
সুরঞ্জিত ছিলেন ন্যাপ মোজাফফর থেকে নির্বাচিত সদস্য। তিনিও ছিলেন সমাজতন্ত্রী। আবদুল্লাহ সরকার সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হলেও মূলত: বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি জাসদে যোগদান করেন। বাকশালে যোগদান করতে অপারগতা প্রকাশ করায় ১৯৭৫ সালের ২৮ এপ্রিল আবদুল্লাহ সরকারের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
সংসদে দেয়া আবদুল্লাহ সরকারের বক্তৃতা-বিবৃতি জাতীয় সংসদের রেকর্ড থেকে সংগ্রহ করে ‘৭৩ এর সংসদে একজন আবদুল্লাহ সরকার’ নাম দিয়ে ৬৬৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি। আবদুল্লাহ সরকারের স্ত্রী এবং তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী তাহেরা বেগম জলি এটি প্রকাশ করেছেন। এক হাজার টাকা মূল্যের বইটির পরিবেশক অঙ্কুর এবং সংহতি প্রকাশনী। বইটির পুরোটাই সংসদের রেকর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশ করা। সে সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঁচ করা যায় এ বক্তৃতামালায়।
আবদুল্লাহ সরকার ১৯৪২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও আজন্ম সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা পোষণ করেছেন এবং সংসদে যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন সর্বত্রই তার বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল। মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে বিরোধী দল গঠন করা হলেও জনাব আতাউর রহমান খান বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ায় আর আবদুল্লাহ সরকার এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সদস্য থাকায় তাদের সংসদে বিরোধী দলের অভাব অনুভব করা যায়নি।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ এক দশক দুনিয়াব্যাপি সমাজতন্ত্রের এক প্রবল জোয়ার বইয়ে ছিল। সেটি অনুপ্রাণিত হয়েছেন কমরেড আবদুল্লাহ সরকার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জীবনের সচেতন সময় থেকেই প্রাণের মানুষের পরিণত হন তিনি। নিজের এলাকার অন্ধকার গোছাতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি দিয়ে গড়ে তোলেন দু’টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে করেছেন প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। নিজের পরিবারসহ জোতদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ঠিকানাহীন ভূমিহীনদের তৈরি করে দিয়েছেন স্থায়ী ঠিকানা।
মেঘনা নদীর জেলেদের সুখ-দুঃখের তিনি ছিলেন আজন্ম সঙ্গী। মেঘনার ত্রাস জলদস্যুদের দমনের জন্য সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন আন্দোলন। আবার সেই সমস্ত জলদস্যুকে ফিরিয়ে আনেন স্বাভাবিক জীবনে। মেঘনা নদীর ভাঙন প্রতিরোধে গড়ে তোলেন নদী ভাঙন প্রতিরোধ জাতীয় সমন্বয় কমিটি। তার কাজের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ।
আবদুল্লাহ সরকারের সংসদের বক্তৃতায় আমি জমি,শিল্প সবকিছু জাতীয়করণের বারবার আহ্বান দেখি। অবশ্য কল-কারখানাগুলো পশ্চিমাদের মালিকানায় হওয়ায় সবই পরিত্যক্ত ছিল। কারণ মালিকেরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় পরিত্যক্ত সম্পদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সরকার নিয়ে নিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কল-কারখানাগুলো পরিচালনা করে সুফল পাওয়া যায়নি। সবটাই রাষ্ট্রীয়করণ করলেও সম্ভবত ফলাফল তেমন কিছু তারতম্য হতো না। বড় ধরনের একটা জাতীয় ব্যর্থতা প্রকট হয়ে দেখা দিতো।
আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়া ও সমাজতন্ত্রের অবক্ষয় শুরু হয়। গর্বাচেভের সময় সোভিয়েত ভেঙে খান খান হয়ে যায়। দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার হিসেবে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে ওঠে। ভ্লাদিমির পুতিন এসে শক্ত হাতে হাল না ধরলে রাশিয়া তার প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলতো। তবে পুতিনের শক্ত পরিচালনায় রাশিয়া পুনরায় একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও তারা বাজার অর্থনীতির বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি রেখেছে তারা একদলীয় ব্যবস্থাটি শুধু ঠিক রাখার জন্য। বিশ্বে এখন কোথাও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর অব্যাহত নেই।
কমরেড আবদুল্লাহ সরকার একপর্যায়ে জাসদ ছেড়ে গড়ে তোলেন বাসদ। দীর্ঘ ৩০ বছর পরে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি মতাদর্শগত বিরোধ এড়িয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর আবার ফিরে যান চিরচেনা হাইমচরে। বাসদে থাকাকালেই তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হন। শ্রমিক নেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন স্বনামধন্য। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ-স্কপ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
মেঘনাপাড়ের সাহসী মানুষ,গরিব মেহনতী মানুষের আজন্ম সঙ্গী কমরেড আবদুল্লাহ সরকার তার প্রিয় জনপদ হাইমচরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ঠিক ৭ বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আবদুল্লাহ সরকারের মৃত্যু হয়। তার স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধা। পরপারে ভালো থাকুন কমরেড আবদুল্লাহ্ সরকার! (বাংলা ট্রিবিউন)
লেখক: আনিস আলমগীর, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।