বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৮ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৮ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে।
বিনিয়োগ নিঃস্ব বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই পাচারের জন্য রাজনৈতিক অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা দায়ী। এ ছাড়া বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাব, ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা, দুর্নীতি, বিচারহীনতা, আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা ও সুশাসনের অভাবে অর্থ পাচার হয়েছে।
এ জন্য টাস্কফোর্স, প্রাইস কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অবৈধ অর্থপ্রবাহ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইন মিলনায়তনে আয়োজিত এ সেমিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ও ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ, অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। দেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৬৬ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে। ওই বছরে ১০০টি দেশের মধ্যে পাচারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। ওই বছর পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের সাড়ে ৩ গুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেটের ৮ গুণ। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দুই বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রজেক্টে বাংলাদেশিরা তৃতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করার কোনো আইনে অনুমোদন নেই। পানামা পেপার্সে ৩৪ বাংলাদেশিদের নাম এসেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা বাংলাদেশিদের অর্থের সন্ধান পেলেও সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য নেই। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ কালো টাকা।
আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশের করহার খুব বেশি নয়। করের কারণে টাকা পাচার হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। ভয়ের কারণে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আইনের দুর্বলতা ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। অর্থনীতিতে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। শ্রমিক রপ্তানিতে অবৈধ টাকা দেওয়া লাগে সংশ্লিষ্ট দেশকে। পাচার রোধে সমন্বিত স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অপ্রতুলতা ও রাজনৈতিক অস্বস্তির কারণে টাকা পাচার বাড়ছে। ২০০৮ সালে তার আগে বছরের তুলনায় অর্থ পাচার ৫৭ শতাংশ বাড়ে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি কারও আস্থা ছিল না। ২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে। কারণ পরের বছর দেশে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। মনস্তাত্ত্বিক কারণে অর্থ পাচার হচ্ছে। মিসপ্রাইসিং, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অর্থ পাচার করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানকারী ও বৈদেশিক মুদ্রার পাচারকারীদের কোনো বিচার হয় না। বাজেয়াপ্ত করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়ার কথা থাকলেও তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করছে। এটিও অর্থপাচারের কারণ। এ জন্য প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) সংস্কার করে সব ক্ষেত্রে চালু করতে হবে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম অথচ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেশি। বিষয়টি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের আমদানি করহার কম হওয়া দরকার অথচ এ দেশে এবারের বাজেটে আরও একটি শুল্ক স্তর সংযোজন করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপিদের পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিনিয়োগ নিঃস্ব দেশ থেকে ক্রমান্বয়ে পুঁজি রপ্তানি হচ্ছে। অধিক সঞ্চয় থাকলেও বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ দেশের বিনিয়োগের জন্য সম্পদের প্রয়োজন। এটি বড় ধরনের প্যারাডক্স। পাচার বন্ধে ৫টি সুপারিশ প্রদান করে তিনি বলেন, কারিগরি সমাধান ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। সামাজিক সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে পাচার বন্ধে প্রতিষেধকমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। টাকা পাচারে উৎসাহিত করে এমন শক্ত আইন ও প্রতিষ্ঠানে সংস্কার করে সহজ করতে হবে। পাচারকারীদের দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করে সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থপাচার একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি অনুধাবনের জন্য গবেষণা করতে হবে।
আবু আহমেদ বলেন, ধনীরা টাকা পাচার করে। তাদের বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মঈনুল ইসলাম খান বলেন, গত ৩ বছরে দেশে ৮৫ মণ স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ দেশে বাণিজ্যিকভাবে কোনো স্বর্ণ আমদানি করা হয়নি।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ রূমী আলী, মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিন, আইসিএবির প্রেসিডেন্ট কামরুল আবেদীন, বিএফআইইউয়ের ডিজিএম ড. কবীর আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান, দুর্নীতি দমন কমিশনের নাসির উদ্দিন, বিআইবিএমের আহসান হাবীব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১:০০ পিএম, ২৬ জুন ২০১৬, রোববার
ডিএইচ