বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অনন্য এক নক্ষত্র নাজিমউদ্দিন মোস্তান। তিনি একাধারে প্রথিতযশা সাংবাদিক, সম্পাদক, সংগঠক, কবি ও লেখক। একজন প্রযুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সম্ভাবনার খবরাদি তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। শুরু তাই নয়, দেশের জনগণের হাতে কম্পিউটার তুলে দিতে এদেশের পত্রিকার পাতায় অগ্রগণ্য ছিলেন। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ এর গোড়াপত্তনে অনন্য ভূমিকা রয়েছে তার। আধুনিক সাংবাদিকদের দাদু বলা হয় জোসেফ পুলিৎজারকে। উইলিয়াম র্যাডলফ হার্স্টদের হাত ধরে যা বিস্তার লাভ করেছে গোটা বিশ্বে। বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম পুরোধা এবং তথ্য প্রযুক্তিতে সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নাজিমউদ্দিন মোস্তান।
যিনি পরিশ্রম, সততা-নিষ্ঠা, কর্মদক্ষ ও বুদ্ধিদীপ্ততায় নিজেকে নিয়ে গেছেন খ্যাতির শীর্ষে। সাংবাদিকতায় তিনি অর্জন করেছেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক। তবে প্রতিটি সৃষ্টি বা অর্জনের পেছনে যে গল্প- কারো জীবনে তা খুব বেশি সহজ বা সুখকর নয়। অমৃসণ আর কষ্টের পথ মাড়িয়েই কেউ কেউ সফল হন তাঁর জীবন ও কর্মে। যেমনটা ঘটেছে দুনিয়া কাঁপানো সাংবাদিক অস্ট্রেলিয়ার উইলফ্রেড ব্রুচেটের বেলায়। তার প্রথম জীবনের গল্পটা অনেক সংগ্রামের।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানের বেলায়ও খ্যাতির এমন উচ্চতায় পৌঁছানোর পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না। আর দশজন সফল মানুষের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। যার ফলে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে কষ্টের এক সুদীর্ঘ পথ। এতোকিছূর পরেও তাঁর সাফল্যের উৎস ছিলো পরিশ্রম, প্রত্যয়ী প্রয়াস আর মা বাবার প্রেরণা। তার স্ত্রীও ছিলেন যোগ্য সহধর্মিনী। তিনিও এই মানুষটির পেছনে কাজ করেছেন নিশ্চুপভাবে।
আলোকিত এই মানুষটির পৈত্রিক ভিটা ও স্থায়ী নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার পশ্চিম সকদী গ্রামে। পিতা হাফিজউদ্দিন মোস্তান ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার। মাতা সায়েরা খাতুন। পিতার চাকরির সুবাদে ১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের একটি হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নাজিমউদ্দিন মোস্তানের সহধর্মিনী নূরজাহান খানম। দাম্পত্য জীবনে তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে নাজমুন নাহার মিলি ও মৌটুসি নাহার মৌ কাজ করছেন গণমাধ্যমে। ছেলে সাব্বির ফয়সল বেসরকারি আইটি কোম্পানিতে কর্মরত।
নাজিমউদ্দিন মোস্তান লেখাপড়া শুরু করেন নিজ গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বছর দুয়েক পর চলে যান চট্টগ্রামে। উদ্দেশ্য মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা। কিছুদিন পর আবার চলে আসেন নিজ বাড়িতে। এরপর চান্দ্রা হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞানে লেটারসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর আবার ফিরতি যাত্রা চট্টগ্রামে। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের দৈনিক সমাচার পত্রিকা প্রুফ রিডার হিসেবে। প্রমিত বানানে দারুণ দক্ষ তিনি ঢাকায় এসে বাংলাবাজারে একটি প্রকাশনা সংস্থায় প্রুফ রিডারের কাজ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানির হককথা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এবং দৈনিক পয়গামের সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৭১ সালে দৈনিক সংবাদ ও ১৯৭৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তার কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ইত্তেফাকেই।
পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদকও ছিলেন তিনি। তার কর্মজীবনে একজন কর্মদক্ষ, পরিশ্রমী ও সৎ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত তিনি। এখনো তার সততা, মেধা আর পরিশ্রমের বর্ণনা দেন তার সহকর্মীরা। আর বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকতায় তিনি রচনা করেছেন এক আশ্চর্য ভাষাবৈভব। তার প্রতিবেদনে নান্দনিক ও বৈচিত্রময় নানা ধরনের উপমার ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। তরুণদের খুব সহজ করে প্রতিবেদন লেখা শেখাতেন তিনি।
সাংবাদিকতায় তিনি সবসময় আধুনিক চিন্তা এবং নতুনত্ব নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। যার সুবাদে তিনি তখনকার সময়ে গোটা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ধারণা ততটা প্রচলিত না থাকলেও এই খাতই ভবিষ্যতকে নেতৃত্ব দেবে বুঝেছিলেন। নাজিমউদ্দিন মোস্তান বুঝতে পেরেছিলেন এই তথ্যপ্রযুক্তিই দেশের উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হেয় দাঁড়াবে। তাই লেখালেখিতে কম্পিউটার প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বিজ্ঞান চিন্তার সম্ভাবনার খবরাদি নিয়মতি তুলে ধরতেন। তখন বাংলা ভাষায় কম্পিউটার বিষয়ক খবর লেখার মতো কেউ ছিলো না।
সম্প্রতি নাজিমউদ্দিন মোস্তার ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত অনলাইন আলোচনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, নাজিমউদ্দিন মোস্তার কেবল সাংবাদিক নন, প্রযুক্তি যোদ্ধাও ছিলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের গোড়াপত্তনে তার ভূমিকা রয়েছে। তার তৈরি করা তথ্য প্রযুক্তির ভিত্তির ওপর আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে।
দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফ এর চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জামান ঐ অনুষ্ঠানে স্মৃতিকথায় তুলে এনেছেন কাজ পাগল নাজিমউদ্দিন মোস্তানের প্রতিকৃতি। জনউদ্যোগ সহযাত্রা নামের একটি কর্মসূচিতে কাজ করেছেন দুইজন। যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন নাজিমউদ্দিন মোস্তান। এইকর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ছুড়ে বেরিয়েছেন। সভা সেমিনার করে সাধারণ মানুষের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং ভালো কাজে প্রতিবন্ধকতার কথা শুনতে হতো। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও জাতির পিতার যে মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেছেন, সেটিকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন ড. খলীকুজ্জামান ও নাজিমউদ্দিন মোস্তান। মানুষের মাঝে সচেতনা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করাই ছিলো নাজিমউদ্দিন মোস্তানের মূল লক্ষ্য।
কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও সমালোচক আহমদ ছফার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান। ছফা সাহেব প্রায়ই বলতেন, নাজিমউদ্দিন মোস্তানের লেখা যে কোনো রিপোর্টই পুরস্কার পাবার যোগ্য। নিজের যোগ্যতা ও সততার জন্যে তৎকালীন সময়ের দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে খুবই শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের মোস্তান ভাই শিরোনামে সাংবাদিক ফজলুল বারী লিখেছেন, সাংবাদিকতায় ভালো কিছু করতে হলে খুব একটা মেধাবী আর সুন্দর চেহারার দরকার নেই। দরকার নাজিমউদ্দিন মোস্তার মতো পড়াশোনা, পরিশ্রম আর সততা।
নাজিমউদ্দিন মোস্তান শেষ দিকে এসে রাষ্ট্র নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেখানে কেবল দেশের সম্ভাবনা এবং উদ্ভাবনের উজ্জ্বল বয়ান লেখা হতো। তবে পত্রিকাটি প্রকাশনা বেশিদিন সচল রাখতে পারেননি তিনি। খুব বেশি পরিশ্রমের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এই অসুখের সাথে সংগ্রাহম করেই ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানের কর্মজীবনের হিসেবে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় একুশে পদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স সম্মাননা, প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা কারিগর সম্মাননা, সমাজ কল্যাণ সংঘ পুরস্কার এবং রোটারি ক্লাব অব রমনা পদক। এছাড়াো বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি এ বিসিএস কম্পিউটার সিটি তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমে ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে নাজিমউদ্দিন মোস্তানের নাম। তিনি বেঁচে থাকবেন জীবন ও কর্মের কল্যাণে।
আশিক বিন রহিম