Saturday, 11 April, 2015 07:36:40 AM
চাঁদপুর টাইমস ডট কম :
আধুনিক তরুণ-তরুণীদের এ কেমন আচরণ! তা দেখুন :
ইন্টারনেটের আগমনে বর্তমান পৃথিবীতে যে জগতের উন্মেষ তা ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে গতিশীল, তথ্যনির্ভর ও সমৃদ্ধ। আর এই জগত্ এ প্রজন্মের তরুণ ও তরুণীদের যুক্ত করছে এক অদৃশ্য সামাজিক ব্যবস্থায়। এর নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (Social Media)। একে বলা হয় ভার্চুয়াল জগত্ (Virtual World)। এ জগতের আচরণ, কথাবার্তা সবকিছুর সমষ্টিকে ভার্চুয়াল জীবনযাপন (Virtual Life) বলা হয়।
বর্তমানে প্রচলিত সোস্যাল মিডিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, গুগল প্লাস, ভাইবার, ইনস্টাগগ্রাম, ফোরাম ও ব্লগ প্রভৃতি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটির ওপরে ব্যবহারকারী নিয়ে সবচেয়ে বড় সমাজ গঠন করেছে মার্কিন তরুণ মার্ক জুকারবার্গ আবিষ্কৃত ফেসবুক। এছাড়া টুইটার ও ব্লগে রয়েছে বিপুলসংখ্যক তরুণ ব্যবহারকারী।
তবে একথাও সত্য এই মাধ্যমগুলোতে বয়স্কদের সংখ্যাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয় এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইন্টারনেটের বিস্ময় সোস্যাল মিডিয়ার যে জগত্ সেই জগতে আশঙ্কাজনক হারে প্রবেশ করছে তরুণ-তরুণীরা। তারুণ্যের ভার্চুয়াল কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে মিডিয়া প্রাঙ্গণ। সেখানে গড়ে উঠছে সম্পর্ক, তা আবার ভেঙেও যাচ্ছে, ঝগড়া হচ্ছে, কৌতুক, প্রেম, ভালোবাসা, বিক্ষোভ, সমালোচনা এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলন। আর এর সবকিছু করতে হয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে। কী তবে সেই সোস্যাল মিডিয়ার ভাষা?
সোস্যাল মিডিয়ায় প্রধানত লিখিত বর্ণে ভাব প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও অডিও, ভিডিও বার্তা এবং বিভিন্ন ধরনের আবেগাশ্রিত সংকেত ব্যবহার করা হয়। ছবি আদানপ্রদানও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। তবে সবচেয়ে বেশি যে ভাষা ব্যবহার করা হয় সেটি হচ্ছে লিখিত বর্ণ। এই ভাষারও প্রতিনিয়ত ভাঙাগড়া চলছে অনলাইন জগতে। এর ফলে ভাষা যে সমৃদ্ধ হচ্ছে এমন ভাবার কিছু নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষার ঘটছে চরম বিকৃতি।
এই নিবন্ধে তরুণ প্রজন্মের ভাষা ব্যবহার বলতে আমরা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের চিন্তাধারা ও ভাষা ব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়েছি। তরুণেরা এখন যে শব্দ ব্যবহার করছে ব্লগে বা ফেসবুক, টুইটারে তা অনেক সময় মূল শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা দেখা যায় বিভিন্ন পোস্ট লেখা, ইনবক্সের বার্তা আদানপ্রদান, মন্তব্য করা বা ছবির শিরোনাম দেওয়ার সময় এবং অবশ্যই ইংরেজি বর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মূল শব্দ Love কে Luv, Come কে Cum, Take care কে TC, Why কে Y, Thanks কে Tnx, You কে U, O my god কে OMG ইত্যাদি লেখা হয়। এটি শুধু বাংলাদেশি তরুণেরা করে তা নয়, বিশ্বব্যাপী সব দেশের তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা রয়েছে। Lol নামের শব্দটি অনেক বেশি প্রচলিত যেটার পূর্ণরূপ Lots of laugh বা Laugh out Loud |
এ তো গেলো ইংরেজি ভাষা ব্যবহার। বাংলার কী অবস্থা? বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় এখন বাংলা ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য। এদিক থেকে তরুণ প্রজন্ম সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশে এক সময় সবচেয়ে সরগরম ছিল ব্লগ, যেটি এখন ফেসবুকের জনপ্রিয়তায় দ্বিতীয় স্তরে চলে গেছে। তবে ব্লগাররা বাংলা ভাষাকে বলতে গেলে বিকৃত করেছে কিছু শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ‘র’ এবং ‘ড়’ এই দুটি বর্ণকে সবচেয়ে বেশি বিকৃত হতে দেখা যায় ব্লগে। আমরাকে ‘আমড়া’, বাড়িকে ‘বারি’, পরাকে ‘পড়া’, ঝড়কে ‘ঝর’, ঝরছেকে ‘ঝড়ছে’। এছাড়া ভার্চুয়াল জগত্ থেকে যেন ‘ছ’ নামের বর্ণটি হারাতে বসেছে। বলছে হচ্ছে ‘বলসে’, খাইতেছেকে—খাইতাসে, আইছেকে আইসে, যাইতেছে—যাইতাসে। এরপর রয়েছে শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ করতে গিয়ে বিকৃতি। ‘মন চায়’ লেখা হয় ‘মুঞ্চায়’, আমারে কে লেখা হয় ‘আম্রে’। এছাড়া পোস্ট করা বা লেখাকে পোস্টানো, ব্লগ লেখাকে ব্লগানো, প্লাসকে পিলাস ইত্যাদি তো আছেই। আর ব্লগে বাংলাভাষায় গালিগালাজের বন্যা বয়ে যায় যেটা আসলে খুবই হতাশাজনক। তবে মতের মিলকে সহমত ও অমিলকে দ্বিমত লেখার ব্যাপক ব্যবহার প্রশংসনীয়।
ভাষা বিকৃতির দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ফেসবুক। এখানে ব্লগের উল্লিখিত বিকৃতি ছাড়াও রয়েছে নানা শব্দের অপপ্রয়োগ। ফেসবুকের বাংলা লেখা থেকে যেন চন্দ্রবিন্দু উঠে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সোস্যাল মিডিয়ায় আরেক ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়। এটি হচ্ছে ইংরেজি বর্ণে বাংলা লেখা। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিকৃত ও হাস্যকর করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহারে বাংলাদেশের তরুণেরা তেমন এগিয়ে ছিল না। অধিকাংশই I hate politics লিখে পালাতো। তবে ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর ফেসবুকে ও ব্লগে রাজনীতি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। একইসঙ্গে কঠিন ও আক্রমণাত্মক ভাষায় দেশের দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের সমালোচনা চোখে পড়ার মতো। আর যে জাতি রক্ত দিয়ে নিজের ভাষার দাবি আদায় করে সে জাতির একটি প্রজন্ম নিজের সমৃদ্ধ ভাষা বিকৃত করে লিখলে তা জাতীয় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারই পারে জাতীয় পরিচয়কে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে।
তারুণ্যের উদ্দীপনায় সোস্যাল মিডিয়ায় যে নতুন সমাজের জন্ম হয়েছে সেটিকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন নিজের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষা, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং দেশের বৃহত্তর কল্যাণকে বিকৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে লক্ষ রাখতে হবে সেদিকে।
মন্তব্য লিখন, বার্তা প্রদান, ছবি প্রকাশের সময় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ যা প্রকাশ বা শেয়ার করা হবে সেটিই প্রকাশকারীর পরিচয়।
এ সম্পর্কে দার্শনিক ওয়েবস্টার লিটবিটারের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণে থাকলে ভার্চুয়াল জীবন পরিচ্ছন্ন এবং কল্যাণমুখী হতে পারে।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/2015