চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মায় টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে বৃহস্পতিবার ২ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে শুরু জেলেগণ করবে ইলিশ শিকার। ২২ দিন বন্ধ থাকার পর মাছঘাটগুলাতে বেড়েছে জেলেদের কর্মব্যস্ততা। মাছ ধরতে নৌকা ও জাল নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাঁদপুরের কয়েক হাজার জেলে। রাত ১২টা বাজলেই নদীতে নেমে পড়বেন মাছ শিকারে।
আজ দুপুরে উপজেলার বিভিন্ন ঘাট ঘুরে দেখা গেছে,নদীতে মাছ শিকারের জন্য জেলেরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এত দিন ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকাগুলো মেরামত করছেন জেলেরা। আবার কেউ কেউ জাল বোনার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিটি ঘাটেই নদীতে নামার জন্য জেলেদের প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে আড়তদাররাও তাদের আড়তগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। দীর্ঘ ২২ দিন বেকার সময় কাটিয়ে নতুন উদ্যমে ইলিশ শিকার ও বিক্রিতে মেতে উঠবেন তারা।
জেলেগণ জানান, ২২ দিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি ও তার নৌকার আট জেলে নদীতে মাছ শিকারে যাননি। এখন নিষেধাজ্ঞা শেষ, তাই তিনি নৌকা মেরামত করছেন। আজ রাত ১২টা বাজলেই নদীতে মাছ শিকারে যাবেন তারা।
তারা আরোও জানায় সরকার অভিযান দেয়ায় আমাদের নিবন্ধিতজেলেরা নদীতে নামেন নি। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু জেলে প্রভাবশালী লোকদের ছত্রচ্ছায়ায় নদীতে মাছ শিকার করেছেন। আবার অভিযান শেষে এ চক্রটিই বিভিন্ন অবৈধ বেড় জাল,পাই জাল,বেহুন্দি জাল দিয়ে মাছের রেণু ধ্বংস করে। এদের এ অবৈধ জাল বন্ধ না করা হলে অভিযানে কোনো লাভ হবে না।
এত দিন অভিযান থাকায় মাছের আড়ত বন্ধ ছিল। অভিযান উঠে যাওয়ায় জেলেরা নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর তাঁরাও মাছ কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আশা করছেন কাঙ্ক্ষিত মাছ পেলে ২২ দিনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন।
এদিকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত চাঁদপুরে ইলিশ রক্ষায় ৫৪৪ অভিযান-৮২ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হযেছে । দেশের ৬টি অভয়াশ্রমসহ চাঁদপুরের নৌ-সীমানায় ১১ অক্টোবর থেকে চলছে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যা ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনব্যাপি চলবে যা আজ রাত ১২ টা পর্যন্ত বলবৎ রযেছে ইলিশ রক্ষার এ অভিযান ।
২ নভেম্বর অভিযানের ২২তম দিন অতিবাহিত হলো। এর মধ্যে পদ্মা-মেঘনায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন,চাঁদপুর সদর,হাইমচর,মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা প্রশাসন,চাঁদপুর কোস্ট গার্ড স্টশন,চাঁদপুর নৌ-পুলিশ জেলা মৎস্য ও উপজেলা মৎস্য বিভঅগ যৌথ বা এককভাবে ১১-২ নভেম্বর পর্যন্ত ঔ অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে।
অভিযান চালিয়ে প্রায় ২০ লাখ ৮৩ হাজার মিটার জাল আটক করা হয়। যার মূল্য হবে ৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার অধিক। এ সময় চাঁদপুর সদর,মতলব উত্তর ও হাইমচরের ৩৬৩ জন জেলেকে আটকপূর্বক মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। জেলা মৎস্য অধিদপ্তর ৪১৪ টি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০৬৪ বার আড়ৎ ও ৩৭০ বার মাছঘাট মনিটরিং,মাছ জব্দ ২ দশমিক ২৯৪ মে.টন জব্দ করা হযেছে ।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের মনিটরিং কক্ষ আজ ২ নভেম্বর ১০ টায় দেয়া ১ নভেম্বর পর্যন্ত ্এ তথ্য জানিয়েছে ।
পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয় সম্পদ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিঠা পানিতে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দিতেই এ অভিযান শুরু। ফলে মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবি পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনা নদীর ৭০ কি.মি.এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করায় চাঁদপুরের অংশ পড়েছে ।
এ সময় ইলিশের আহরণ, ক্রয়-বিক্রয়,মজুদ ও পরিবহণ করা যাবে না। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অভিযানকালীন সময়ে একশ্রেণির অসাধু মৎস্য শিকারীগণ থেমে নেই। তারা গোপনে নদীতে মাছ ধরে তা বিক্রি করে যাচ্ছে। আর অভিযান সফল করতে কঠোর মনোভাব নিয়ে প্রতিদিনই নদী এবং মৎস্য আড়তে কঠোর অভিযান অব্যাহত রেখেছে টাস্কফোর্স সদস্যরা।
প্রসঙ্গত ,ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে দেশের সব প্রজননগুলোতে ২২ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে ইলিশ ধরা,আহরণ,বিক্রি ও বিপণন বন্ধ থাকবে। ইলিশের এ প্রজনন সময়ে সরকারের মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে জেলেদের ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।
এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৬ টি জেলার ১শ ৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার জেলে পরিবারের জন্য খাদ্যসহায়তা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরুর আগেই এ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। দেশের প্রজননের সময় জাটকা ধরা নিষিদ্ধকরণ ও ইলিশ ধরা বন্ধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার এ সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট,নদীকেন্দ্র চাঁদপুর জানিয়েছে।
দেশে গত অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মে.টন।যেখানে ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার মে.টন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ লাখ মে.টনে হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণ বন্ধ করে মাছের অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করে ও সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে।এবার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, জাটকা সংরক্ষণ,মা ইলিশ আহরোণ বন্ধ রাখায় ইলিশের উৎপাদন বাড়বে বলে জানা যায়। বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীসমুহ আরো ইলিশ সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অভয়াশ্রমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমনকি ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও অঞ্চলটি ৮২ কি.মি.অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে মৎস্য বিভাগ।
এ প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা ও স্থাপনের নির্মিত্তে জোর সুপারিশ করা হয়। এক একটি অভয়াশ্রম হচেছ এক একটি রূপালী ইলিশ উৎপাদনের কারখান। প্রয়োজন শুধু ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন। তাহলেই বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের ও সহনশীল উৎপাদনের গতিধারা বজায় থাকবে এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে।
আবদুল গনি,
নভেম্বর ২ , ২০২৩