আজ বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস

আজ বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস

আজ ২২ মে বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস। পৃথিবীতে হাজারো প্রাণী বাস করে । তাদের নাম, পরিচিতি আর স্বভাবের কথা তুলে ধরতে গেলে হাজার পৃষ্ঠায় কোটি শব্দ লিখলেও শেষ হবে না । আধুনিক পৃথিবীতে এখন সব জায়গাতেই মানুষের পদচারণা ।

মানুষ বংশ বিস্তার করছে চক্রবৃদ্ধি হারে। প্রতিনিয়ত: খাবার ও বসবাসের জায়গা খুঁজছে মানুষ । বন জঙ্গল পরিষ্কার করে গাছ কেটে ফেলছে। নদীতে বাঁধ দিচ্ছে এবং বালু বা কংক্রিট দিয়ে মাটি ঢেকে দিচ্ছে। বিশুদ্ধতার সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে সব ধরনের দূষণ।

মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি মিলিয়েই আমাদের পৃথিবী নামের সবুজ গ্রহটি। বিশ্ববাসীর ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র এ জীবমন্ডলটি রয়েছে। মানুষ এটিকে এতোটাই নির্দয়ভাবে ও নির্বিচারে ব্যবহার করছে । বর্তমানে সমস্ত বিশ্ব ব্যবস্থাই হুমকির দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে।

জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২২ মে দিন টি বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবসের ধারণটির সূচনা হয় ১৯৯২ সালে। রাষ্ট্র, সরকার ও পৃথিবীর বড় বড় সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ব্রাজিলের রিও-তে শীর্ষ ধরিত্রী সম্মেলন-এ জীব বৈচিত্র্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

মানুষই বিভিন্ন ভাবে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করে পৃথিবীর পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। যার ফলে বিপন্ন হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। দূষণের পেছনে মানুষের চাহিদা আর অবস্থানের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত ।

বিশেষ করে শিল্পোন্নত ২০ দেশের উৎপাদিত ৮০ শতাংশ ক্লোরো-ফ্লোরো কার্বন ডাই অক্সাইড দিচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা।

ফলে প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার স্ব স্ব নির্দিষ্ট পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। যানবাহনের জন্য ব্যাপক হারে জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নত জীবন যাত্রার জন্য বন্য প্রাণীর আবাস¯’ল উজাড় হচেছ ।

নদী ও বন দখল করা হলো মানুষের এখন আগ্রাসন মানসিকতা । স্বাভাবিক ভূমি কিংবা কৃষি জমি ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসিক বাস¯’ান , হোটেল, রেস্তোঁরা , স্কুল, কলেজ ,মাদ্রাসা , খেলার মাঠ, বড় বড় সপিং মল, পার্ক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাট,বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ,নতুন নতুন অট্টালিকা , অফিস ,আদালত, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান , রেল ও সড়ক পথ।

যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণেও বেড়ে চলছে বিপর্যয়। পাহাড় কাটা,নদী ও মাটির গভীর থেকে বালু তোলার মতো অবিবেচক কাজও করে চলছে মহল একটি বিশেষ। দেশের প্রতিটি জেলায় রযেছে শত শত স’ মিল । এ গুলির চাহিদা মেটাতে কিংবা ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে ও আসবাবপত্র বানাতে অবাধে নিজদের গাছ কাটা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।

বনভূমি ধ্বংস করছে কিš‘ বিপরীতে বৃক্ষরোপন তেমন হচ্ছে না । এ ছাড়া দেশীয় পরিবেশে বিদেশী এবং ক্ষতিকর গাছ রোপনের প্রক্রিয়াও বিপর্যয়কে বাড়িয়ে তুলছে বলে পরিবেশবিদরা বলছেন। অনেক প্রজাতির গাছ বাংলাদেশে রোপন করা হচ্ছে যে সবের ফল দেশীয় পাখিরা খায় না।

এসব গাছে পাখিরা বাসাও বাঁধে না। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীকুল। মানুষও নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিবর্তন হচ্ছ্।ে মানুষের মধ্যে আচার –ব্যবহারেরও পরিবর্তন লক্ষণীয়। নানা অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। মানুষের সামাজিক,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচেছ।

এক তথ্য মতে, আমাদের দেশে সুন্দরবন সহ ৪০ প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী আজ বিপন্ন,অতিবিপন্ন বা সংকটাপন্ন অব¯’ায় রয়েছে। বন বিনাশ, পিটিয়ে মারা,শিকার,বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত, পর্যাপ্ত খাবার ও প্রাকৃতিক বন্যা,মহামারি, দুর্যোগ,ঘূণিঝড় ও আশ্রয়ের অভাবে এ সব প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। অন্য এক তথ্যে জানা যায় , পৃথিবীতে ১০ কোটি জীব বৈচিত্র্য রয়েছে- এর মধ্যে ১ কোটির সন্ধান লাভ করেছে মানুষ।

পৃথিবীর বৃহত্তম ৩টি ম্যানগ্রোব এর মধ্যে বাংলাদেশের সুন্দরবন একটি । এর আয়তন ১০ হাজার কি.মি.। আর বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কি.মি.। জীববেচিত্র্যের দিক থেকে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম।

এ বনে ২ শ’৭০ প্রজাতির পাখি,৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবা¯’ল। এর আশ-পাশের লোনা পানিতে রযেছে হাঙ্গর,কুমির,ডলপিন ও ২ শ’৫০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

এ সব আজ নানা হুমকীর সম্মুখীন। সমুদ্র পথে চলাচল কারী লাইটার দেশি-বিদেশি জাহাজগুলি থেকে নির্গত নান রকমের তৈল পানিতে মিশে এদের জীবনকে বিপন্ন করে যাচেছ।

পরিবেশবিদদের মতে, জীববৈচিত্র ধ্বংসের ক্ষেত্রে নদীর মূমুর্ষতাও একটি বড় কারণ। অপরিকল্পিতভাবে নদীতে বাঁধ দেয়া ও দূষণের মাধ্যমে এদেশের অসংখ্য নদী ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছে। ফারাক্কাই তো এর উদাহরণ । এক সময়ে বাংলাদেশে দেড় হাজারের মতো নদী ছিল।

ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যাসহ আশ –পাশের নদ-নদীগুলির অবস্থা করুণ। বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি চাঁদপুরের ষাট নল পর্যন্ত এসে গেছে । বুড়িগঙ্গার দুষিত ও দুর্গন্ধ্যময় পানি আজ এ মিঠা পানির সাথে মিশে দূষিত হয়ে যাচ্ছে ্। ফলে পৃথিবীর বিখ্যাত ইলিশ মাছ মেঘনা ছেড়ে পালাবে।

এর সাথে অন্যান্য সু-স্বাদু মাছ ও প্রাণিজ সম্পদ হারাতে হবে। এর পানি কৃষি কাজে ব্যবহার অযোগ্য বলে বিবেচ্য হবে। অথচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিঠা পানি হচেছ মেঘনা নদীর পানি ।

এ দিকে ভারত যদি টিঁপাইমুখ বাঁধ বেঁধে ফেলে তাহলে মেঘনা নদীর অস্তিত্ব থাকবে না । ইলিশ সহ সকল প্রকার মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে । কৃষি ও জীব বৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পতিত হবে ।

দখলজনিত কারণে দেশের ১৫৮টি নদী এখন রুগ্ন হয়ে পড়েছে। ১৭টি নদী একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অন্তত: ৮টির অবস্থা এখন বিলুপ্তির পথে। সারা দেশে এখন মাত্র শ’খানেক নদী আছে যেগুলো দিয়ে নৌ-চলাচল করছে।

২০০৯ সালে কোপেনহেগে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে যেসব কেসস্ট্যাডি উপস্থাপিত হয় তাতে বাংলাদেশের ক্ষতির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সম্মেলনে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবের অন্যতম শিকার বলে সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন। এখনই আমরা ঋতুগুলির বৈশিষ্ঠ্য পর্যৃালোচনা করলে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখতে পারছি। বিগত ক’বছরের শিশির বা তুষারপাতই এর প্রমাণ দিচ্ছে। ফালগুন ও চৈত্র মাসেও আমরা শীতের প্রভাব দেখছি।

সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা, স্বাদু পানি প্রবাহ হ্রাস, লোনা পানির অনুপ্রবেশ ও লবণাক্ততা সৃষ্টি হতে পারে। জলবায়ূর নেতিবাচক প্রভাবে পরিবেশ দূষিত ও জনজীবন বিপন্ন হচ্ছে ।

এ ছাড়াও দেশটির জীব বৈচিত্র ধ্বংসের কারণ হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, জলাভূমি ভরাট, নদীর নাব্যতা হ্রাস, কৃষিতে অপরিকল্পিত ভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার ও নগরায়নকে দায়ী করা হয়।

ইট-ভাটা তৈরি, অপরিকল্পিতভাবে মোটরযান বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিক্ষেপের মতো কারণও কম দায়ী নয়। এসবই জীববৈচিত্র্যকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ধারাবহিকতা চলতে থাকলে আমাদের দেশ এক সময় অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হবে।

তাই বিশ্ব জীব বৈচিত্র দিবস বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে এটি সারা বিশ্বে পালিত হলেও প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বতন্ত্র্য ।

ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও টেকসই পরিবশে রক্ষার লক্ষ্যেই এ ধরনের একটি দিবস পালন করা জরুরি হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করা হলেও ২০০১ সাল থেকে এটি বর্তমানে প্রতিবছর ২২ মে পালন করা হচেছ। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটি পালনের জন্য ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন করে।

কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে এ দিনটি সরকারি ভাবে বন্ধ থাকায় ২০০০ দিবসটির তারিখ পরিবর্তন করে ২২ মে করা হয়। এর কারণ হিসাবে ১৯৯২ সালের ২২ মে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ভাবে নাইরোবিতে জবি বৈচিত্র্য দিবস পালন করা হয বলে ওই তারিখটি ঠিক রেখে তা পালিত হয়ে আসছে।

সুতরাং, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় একটি বৈশ্বিক। এটি কোনো নির্দিষ্ঠ দেশ বা কোনো ভৌগোলিক সীমা রেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। প্রকৃতি,পরিবেশ ও জলবায়ূর সাথে জীব বৈচিত্র্যের সম্পর্ক বিদ্যমান। পৃথিবীকে সুন্দর,পরি”ছন্ন ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করতে উন্নত,উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশকে জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাঁচতে হলে একযোগে কাজ করতে হবে।

]আবদুল গনি

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪:০০ পিএম, ২২ মে ২০১৬, রোববার
ডিএইচ

Share