আজ (২২ জুন ) রাত বা রমজানের ২৭ তম রাত সাধারণভাবে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত হিসেবে পরিচিত। আভিধানিকভাবে লাইলাতুল কদর অর্থ সম্মানের রাত। সূরা কদরে ঘোষণা করা হয়েছে-লাইলাতুল কদরের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি।
তাফসিরের কিতাবগুলোতে উল্লেখ রয়েছে এক দিন নবী করিম (সা.) এ ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন যে, আগের নবীর উম্মতেরা দীর্ঘ হায়াত পেতেন। ফলে তারা অনেক বেশি ইবাদত বন্দেগির সুযোগ পেতেন। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতের হায়াত খুবই সীমিত। তাদের পক্ষে উচ্চ মর্যাদা লাভের সুযোগ কম। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সূরা নিয়ে উপস্থিত হন হজরত জিবরাইল (আ.)।
ফলে শান্ত হন মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিরা। আল্লাহতায়ালা এ রাতেই কোরআন মজিদ নাজিল করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেমনি এ রাতটির মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি বলেও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু রাত কোনটি তা বলে দেননি। হাদিস শরিফেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কোনটি কদরের রাত। নিঃসন্দেহে এতে অনেক রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে। তবে রসুলুল্লাহ(সা.) রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন।
ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে রাতটি কাটাতে পারলে এ রাতের সুফল পাওয়া যায়। কোরআন মজিদের বর্ণনা অনুযায়ী, এ এক রাতে ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াবের চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। হয়তো আল্লাহতায়ালা ও তার রসুল (সা.) চাননি মুসলমানরা একটি রাতের ভরসায় বসে থেকে সারা বছর বা সারা মাস অবহেলায় কাটিয়ে দিক। এজন্য এটিকে রহস্যময় করে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমেই মূল্যবান কিছু অর্জন করতে হয়। যে রাতের মূল্য হাজার মাসের চেয়ে বেশি, তা যদি সহজে পাওয়া যেত, তা হলে মানুষ হয়তো এটিকে বেশি গুরুত্ব দিত না।
তাই তা অনির্দিষ্ট করে রেখে মানুষকে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে। কেউ কেউ রমজানের যে কোনো অংশে এ রাত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু বেশির ভাগ মনীষীর মতে রমজানের শেষ দশকেই তা রয়েছে। আবার কারও কারও মতে, এ রাতের তারিখ পরিবর্তনশীল। কোনো বছর একুশ, কোনো বছর তেইশ, কোনো বছর পঁচিশ, কোনো বছর সাতাইশ, আবার কোনো বছর ঊনত্রিশ তারিখের রাত লাইলাতুল কদর হয়।
কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক মনীষী রমজানের ২৭ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যাপারে সাহাবিদের মধ্যে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ কারি হিসেবে আখ্যায়িত হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য।
তিনি জোর দিয়ে বলতেন, রমজানের ২৭তম রাতই কদরের রাত। অন্য দিকে ফিকাহ ও ইজতেহাদের জ্ঞানে চার খলিফার পরেই যার স্থান, সেই হজরত আবদুল্ল্হা ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন এটি রমজানের বাইরেও হতে পারে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মন্তব্য সম্পর্কে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলতেন, আমার ভাই আবদুল্লাহ ভালো করেই জানেন, এটি রমজানের মধ্যে এবং তা ২৭তম রাত।
লোকেরা এ রাতের ভরসায় বসে থাকবে এবং আলসেমিতে সারা বছর ও সারা রমজান মাস কাটিয়ে দেবে এ ভয়ে তিনি তা লোকদের জানাতে চান না। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন ২৭ রমজানের রাতটিই কদরের রাত? জবাবে তিনি বলেন, এ রাতের যেসব আলামত মহানবী (সা.) আমাদের বলেছেন, আমরা সেগুলো ২৭ তারিখে পেয়েছি।
হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-সহ এক দল মনীষীর ব্যাপারে বলা হয়, তারা রমজানের ২৭ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদর বলে মনে করতেন। এসব মনীষীর নাম যুক্ত হওয়ায় রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতটি অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করার ধারা চালু হয়েছে।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কদরের রাতের যে মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য,তার মূল উপাদান কোরআন মজিদ। শেষ নবীর উম্মতের জন্য জীবন ব্যবস্থার চূড়ান্ত নির্দেশনা হিসেবে কোরআন মজিদ নাজিলের সঙ্গে রাতটি সম্পর্কিত হওয়ায় এ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত হয়েছে।
এ রাতের সুফল পুরো মাত্রায় পাওয়ার জন্য কোরআন মজিদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করাই আসল উপায়। কোরআন পাঠ ও অধ্যয়ন এবং কোরআনি বিধান মতে জীবন পরিচালনায় রয়েছে মানুষের প্রকৃত সাফল্য।
লাইলাতুল কদরে সালাত, তিলাওয়াত ও জিকির তাসবিহের সঙ্গে যেমন অতীত জীবনের পাপরাশি মোচনের জন্য মহান প্রভুর কাছে আকুল আবেদন জানাতে হবে,তেমনি তওফিক প্রার্থনা করতে হবে কোরআনকে জীবনের দিশারি হিসেবে মেনে চলার।
লেখক : মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী,বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।