বৈশাখের শুরু হতে-না-হতেই বিয়ের ধুম পড়ে যায়। শহর-উপশহর, রাজধানীর কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে থাকে এ নিয়ে শোরগোল। দুই মাস আগে থেকেও সহজে মেলে না কোনো একটির বুকিং। তবু অভিভাবকেরা দমে যান না। যেভাবে হোক তারা তাদের আয়োজন ঠিকই সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় রাখতে চান না এক বিন্দু ত্রুটি। এত গেল আয়োজনের কথা। তারা কেমন পাত্র চান? পাত্রের পরিবার কেমন হওয়া উচিত? এ নিয়ে কথা হয় কয়েক দিন পরে বিয়ে সম্পন্ন হবে, এমন কয়েকটি পরিবারের সাথে।
সালমা সিকান্দার রিপা। একজন গৃহিণী। তাদের দুই মেয়ে। ছন্দা সিকান্দার ও সাফিয়া সিকান্দার। ছন্দার বিয়ে হয়েছে প্রায় ছয় বছর হলো। সাফিয়ার এ মাসের শেষের দিকে বিয়ে। ছেলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বাড়ি তাদের নিজ অঞ্চলেই, জানান মা সালমা। তিনি বলেন, আমার মেয়ে শিক্ষিত এবং দেখতেও মন্দ না। আমাদের পারিবারিকভাবে আছে সুনাম। তাই অনেক আগে থেকেই মেয়ের আনেক ভালো ঘর ও ভালো পাত্রদের পক্ষ থেকে এসেছে প্রস্তাব। কিন্তু মেয়েকে রাজি করাতে পারিনি। অবশেষে ব্যাটে বলে মিলে যাওয়ায় হয়েছি রাজি। মেয়ের পছন্দ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ছোট পরিবার ও ছয় ফুট উচ্চতার অধিকারী ছেলে। মেয়ের মতকে তো আর অগ্রাহ্য করা যায় না! তাই ধৈর্য ধরেছি। পাত্রের চরিত্র, স্বভাব ও চরিত্রের ব্যাপারে তাদের মেয়ে সাফিয়ার নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ ছিল কি না? জানতে চাইলে সালমা জানান, মেয়ে তেমন জোরালোভাবে কিছু বলেনি। তবে সবারই শালীন ও ভদ্র ছেলেই তো কাম্য। তিনি এক কথায় বোঝানোর জন্য বলেন, ‘সোনার আংটি বেঁকাও ভালো।’ প্রতিষ্ঠিত একটি পাত্রের যদি সামান্য কিছু ত্রুটি থেকেও থাকে, তাতে দোষ কী!
হাসিনা জামান লিনা। অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা। লিনার একটিই মেয়ে। জেসমিন জবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী। লিনার মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিয়ে। পাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই খণ্ডকালীন শিক্ষক। মা লিনা জানান, মেয়ে পরিবারে একটাই মাত্র সন্তান। তাই ওর ওপরে তেমন জোরও খাটাইনি। শুধু বলতাম, তোমার যদি কাউকে ভালো মনে হয় তাহলে জানিয়ে দিয়ো। কখনো কিছু বলেনি। মাত্র দুই মাস আগে জানাল ওর একজনকে পছন্দ। ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে কিছু দিনের মধ্যে জাপান যাবে। এ কারণে যত শিগগিরই সম্ভব ওদের পরিবার বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতে চাচ্ছে। লিনা জানান, আগেভাগে প্রস্তুতি না থাকায় খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদিও আমার মেয়ে এবং তার পছন্দের ওপর আস্থা আছে আমার। তবু আমরা তো অভিভাবক। সে কারণেই পুরো খোঁজখবর নিয়ে তবেই বিয়েতে মত দিয়েছি। পাত্রের পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল। পাত্র দেখতেও সুদর্শনের কাতারে পড়ে না। উপার্জনের অধ্যায়টাও পাকাপোক্ত না। তবুও আশপাশে খবর নিয়ে জেনেছি- এমন চরিত্রবান, মেধাবী, সৎ ও ভালো পরিবারের দেখা মেলা সত্যিই কষ্টের। ভেবে নিয়ে সব তো আর অর্থ, ক্ষমতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। হোক দরিদ্র তাতে কী! আমার মেয়ে যে এমন একজন জীবনসঙ্গী পাচ্ছে, এতেই আমরা মহাখুশি বলেও জানান মা হাসিনা জামান লিনা।
রোকেয়া ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বহু দিন শিক্ষকতা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রোকেয়া ইসলামের তিন ছেলে। বড় দু’টিকে প্রায় দশ বছর আগেই নিজ দায়িত্বে বিয়ে করিয়ে দেন। আগামী জুনে ছোট ছেলের বিয়ে বলে জানান রোকেয়া ইসলাম। তার ছেলে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে বলে, বিয়ে করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বলে জানান এই মা। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে গুণগত মানের চেয়েও পাত্রের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, যোগ্যতা, আর্থিক বিষয় আসয়গুলো পাত্রী পক্ষের কাছে বেশি অগ্রাধিকার পায়। সে ক্ষেত্রে পাত্রের যদি চরিত্রগত সমস্যা, ব্যবহারে অভদ্রতা প্রকাশও পায় তা অনেক ক্ষেত্রেই পাত্রী পক্ষ সহ্য করে। বিষয়টিকে দেখে না কাকতালীয়ভাবেও। হ্যাঁ অবশ্যই মানি, প্রত্যেক পরিবারে আর্থিক নিশ্চয়তা থাকলে কিছুটা হলেও নির্ভরতা পাওয়া যায়। তবে যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাদের নির্ভরতা কী নেই! মানি, অনিশ্চয়তা আছে। তবু তারাও তো জীবনসমুদ্র পাড়ি জমাচ্ছে।
শিক্ষক রোকেয়া ইসলাম ব্যক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, এমন অনেককে চিনি যারা পাত্রের পরিবার, স্বভাবগত বিষয় আসয় গুরুত্ব না দিয়ে শুধু পাত্রের কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছয় মাস যেতে-না-যেতেই পাত্রকে অসহ্য মনে করে। মেয়ে দাম্পত্য সম্পর্ক এড়িয়ে যেতে হয় উদ্বিগ্ন। কিন্তু নিজ ও আপন পরিবারের মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে, বিষয়টি যায় চেপে। কষ্টগুলো ধামাচাপা দিয়ে চলে। কিন্তু এভাবে ক’দিন।
সত্যের মুখোমুখি সবাইকে একদিন দাঁড়াতে হয়। মেয়ে বিয়ে দেয়া সত্যিই কঠিন কাজ। কারণ মেয়ের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য পাত্রপক্ষের টাকাপয়সা, প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি পাত্রের সৎ গুণাবলির। টাকাপয়সা কম থাকলেও পাত্রের সৎগুণের যদি ঘাটতি না থাকে তাহলে সে পাত্রই ভালো বলা চলে।