আমার ছেলের নাম ছিল অভি। অনেক শখ করে তার নামটা রেখেছিলাম। ভাবছেন হয়তো বা ছিলাম কেন বলছি। কারণ আজকে আমার ছেলে আমার সাথে নেই। সে অনেক দূরে চলে গেছে। অনেক দূরে। আমাদের সবার থেকে অনেক অনেক দূরে।’
এভাবেই ক্যামেরার সামনে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন এক মা। নিজের নাম, পরিচয় বা ছবি কোনো কিছুই প্রকাশ না করার শর্তে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোর কথা প্রকাশ করলেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই। যেন তাঁর জীবনের ঘটনা থেকে অন্যরা কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতে পারেন।
অনেক আদর করে ছেলেকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন বলে জানালেন এই মা। ব্যবসায়ী স্বামী পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। এসবের মধ্যে তিনি চাইতেন, তাঁর ছেলেকেও যেন তাঁর মতো পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করে জীবন পার করতে না হয়। তিনি চাইতেন তাঁর ছেলে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হোক। বাবা চাইতেন ছেলে বড় ব্যারিস্টার হবে।
অভি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, তখন কোনো কারণে তার পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। এতে তার বাবা ভীষণ রেগে যান বলে জানান অভির মা। এমনকি অভির দাদাবাড়ির সদস্যরাও পরীক্ষায় খারাপ ফলের জন্য তার মাকে দোষারোপ করতে থাকেন। সবাই বলতে থাকেন যে, মা অভির ঠিকমতো খেয়াল নেননি।
এসব আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ছেলের ওপর চাপ দিতে থাকেন মা। ছেলেকে নিয়েই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন তিনি। সে ঠিকমতো বাড়ির কাজ করছে কি না, অযথা সময় নষ্ট করছে কি না এসব খেয়াল রাখতে শুরু করেন। ছেলেকে সব সময় পড়ালেখায় মনোযোগী হতে বলতেন বলেও জানালেন এই মা। ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু তিনি একাই করতে শুরু করেন। একসময় তাঁর জগৎই হয়ে যায় অভিকেন্দ্রিক।
এরপর অভি যখন অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে, তখন পরিশ্রমের ফল পান এই মা। জানালেন, সে বছর ভালো ফল করে তাঁর ছেলে। কিন্তু এর পর থেকে অভির ওপর তার বাবার নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়। অভিকে যে করেই হোক জিপিএ ফাইভ পেতে হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
এ ছাড়া পরিবারের অন্যরাও বারবার অভিকে মনে করিয়ে দিতে থাকেন যে সামনের মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষায় তাকে সেরা ফলটাই করতে হবে। অভির বাবা বলতেন যে, ছেলে জিপিএ ফাইভ না পেলে তাঁর মান-সম্মান নষ্ট হবে, পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে। এ ছাড়া ছেলেকে ব্যারিস্টার বানানোর তাঁর যে স্বপ্ন সেটিও পূরণ হবে না।
ফলে অষ্টম শ্রেণি থেকেই অভির ওপর চাপ দেওয়া শুরু হয়। এই মা বলেন, ‘ও খেলতে পছন্দ করত, ছবি আঁকতে পছন্দ করত, আস্তে আস্তে দেখলাম ওই জিনিসগুলার ভেতরে ছেলেটা কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। জিনিসগুলার প্রতিও তার মন উঠে যাচ্ছে। ছবি আঁকা বন্ধ করে দিছে। আমি তারপরেও বলি যে ঠিক আছে, তোমাকে পড়াশোনা করতে হবে। কারণ আমারও ওর বাবার থেকে যে চাপটা আমি পেতাম, হয়তো বা সেটাই আমি আমার ছেলেকে দিয়ে এসেছি।’
এসএসসি পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসছিল, অভির ওপর ততই চাপ বাড়াচ্ছিলেন বলে জানান তার মা। বলেন, ‘ওর বাবা আমাকে প্রতিনিয়ত কী করছে, ছেলে কী করছে, ছেলের দিকে খেয়াল রাখতেছো? ওকে দেখতেছো? ও কী পড়াশোনা করতেছে? কী করতেছে?’
মূল পরীক্ষার আগে বিভিন্ন টেস্ট পরীক্ষায় অভির ফল ভালো হচ্ছিল না উল্লেখ করে মা বলেন, এগুলো দেখে অভির বাবা প্রচণ্ড রেগে যান। সেই রাগের মাত্রা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না বলে জানান তিনি। অভির বাবা বলেছিলেন, অভি জিপিএ ফাইভ না পেলে তিনি ছেলের মুখও দেখবেন না।
এরপর একসময় পরীক্ষা শেষ হয় অভির। সে আরো চুপচাপ হয়ে যায় বলে জানান তার মা। চুপচাপ এক কোণায় পড়ে থাকত। অথচ আগে সে বেশ হইচই করত।
এভাবে রেজাল্টের দিন এসে গেল। সকালে ভয়ে কাতর চেহারা নিয়ে অভি বের হয়। মা বলেন, “আমি বাসায় অপেক্ষা করছি। সকাল পেরিয়ে দুপুর পার হয়ে গেল, তারপরেও তার কোনো খবর নাই। আমি ওর কিছু বন্ধু-বান্ধব যারা, ওর তো তেমন বন্ধুও আমি হতে দেই নাই আসলে, ওর কিছু পরিচিত মানুষ যারা ওর ক্লাসে ছিল, ওর সাথে কোচিংয়ে যেত ওদের থেকে খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কেউ বলতে পারে না আসলে আমার ছেলে কোথায়। আমি ওর বাবাকে জানালাম। ওর বাবা তো আমার সাথে প্রচণ্ড রাগারাগি চেঁচামেচি শুরু করল। ‘কী বলো তুমি, খেয়াল রাখো না, কেমন মা তুমি? কিছুই করতে পারো না। ছেলেটাকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারো নাই’।”
সন্ধ্যায় অভির বাবাসহ থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন তাঁরা। এর পরদিনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অভি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার দুদিন পর থানা থেকে ফোন আসে। পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, তাঁদের প্রিয় অভি আর বেঁচে নেই। বাড়ির কাছের একটি রেললাইনের ধারে পড়ে ছিল তার লাশ।
পরে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, অভির শরীরে বিষের নমুনা পাওয়া গেছে। সম্ভবত বিষাক্ত কিছু খেয়ে রেললাইনে আত্মহত্যা করেছে।
জানা যায়, অভি জিপিএ ৫ পায়নি। সে জন্য আর ঘরে ফেরেনি সে। মা বলেন, ‘ফিরতই বা কীভাবে। বলেই তো ফেলেছিলাম যে তোর মুখ আর কোনোদিন দেখব না। তাই আমার ছেলে ঘরেই ফেরে নাই। ফিরল না। আজকে আমি নিঃসন্তান। শুধু কেন? জিপিএ ফাইভের জন্য। আমি তাকে এতটাই চাপ দিছি জিপিএ ফাইভ পেতে হবে সেই ভয়ে আমার ছেলে আজকে আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আজকে আমি বুঝি সে কতটা কষ্ট মনে নিয়ে এরকম একটা কাজ করে ফেলছে।’
ক্যামেরার সামনে কাঁদতে থাকা এই মা বলেন, ‘মা হিসেবে আমি ব্যর্থ। আমি আমার ছেলেকে কখনো বোঝার চেষ্টা করি নাই। কখনো তাঁকে কাছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করি নাই, বাবা তোর কী ভালো লাগে, তুই কী করতে চাস? তোর কি কষ্ট হচ্ছে না কি তাও কখনো জিজ্ঞাসা করি নাই। শুধু সারাক্ষণ পড় পড় পড় পড়। পড়তে হবে, পড়তে হবে, জিপিএ ফাইভ পেতে হবে।’
‘আজকে আমার ছেলে নাই আমার কাছে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকটা যেন স্বগতোক্তি করেন এই মা।
নিজের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষা থেকে অন্য অভিভাবকদের প্রতি সন্তানদের ওপর চাপ না দিতে অনুরোধ করেন তিনি। বলেন, সবাই যেন সন্তানকে কাছে ডেকে নিয়ে তার ভালো মন্দ, ইচ্ছা অনিচ্ছা জানতে চান। শুধু জিপিএ ফাইভ পাওয়ার আশায় জীবনের মূল্যবান সম্পদ সন্তানকে যেন কেউ হারিয়ে না ফেলেন সেই কথা বলেন তিনি।
তাঁর মতো যেন আর কোনো মাকে কাঁদতে না হয়, আফসোস করতে না হয় সেই কথা বলেন এই মা। (এনটিভি)