আজ ২৩ জুন উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয়া মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটি উপমহাদেশের রাজনীতিতে ৬ দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছে।
এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রত্যুজ্জ্বল। আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলধারা। আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের কাদা-মাটি গায়ে মাখা খেটে খাওয়া মানুষের দল। আওয়ামী লীগ মানেই জাতির অর্জন, সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার স্বর্ণালি দিন। অতীতের মতো বাংলাদেশের ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯ ৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর যুগান্তকারী নির্বাচন আর ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন সবখানেই সরব উপস্থিতি ছিল আওয়ামী লীগের।
১৯৪৯ সালে দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু। এ বছরের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
প্রথম কাউন্সিলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দী।
বন্দী অবস্থায় তাকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রথম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। পরে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বহাল থাকেন।
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। আর মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকা- স্থগিত করা হয়। ১৯৬৪ সালে দলটির কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি পদে তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন।
১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ।
এর পরে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এ কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় পঁচাত্তরে কারাগারে ঘাতকদের হাতে নিহত জাতীয় নেতাদের অন্যতম এএইচএম কামরুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন মো. জিল্লুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আসে আওয়ামী লীগের ওপর মরণাঘাত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারো স্থগিত করা হয়।
১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।
১৯৭৭ সালে এ কমিটি ভেঙে করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এতে দলের আহ্বায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জাক।
এরপরই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া।
সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
তবে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালে (যুক্ত ফ্রন্ট), ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার হিসেবে ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
সংগ্রাম ও সাফল্যের ৬৫তম পূর্তি, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে আছে- আজ সকাল ৯টায় ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং দলীয় কার্যালয় উদ্বোধন। আর বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে দলের বর্ধিত সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ খুলছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বার
আওয়ামী লীগের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেন্দ্রে থাকছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ভবনের উদ্বোধন। গত বছর দলের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। আজ তার হাত ধরেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে নয়নাভিরাম এ ভবনটি।
১০ তলা এই ভবন উদ্বোধনের পর গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নতুন কার্যালয়ের চাবি তুলে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন শেষে প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম-সম্পাদকসহ অন্য নেতা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর জায়গা নির্ধারণ করে দেবেন।
সামনের দেয়ালের দু’পাশ কাচ দিয়ে ঘেরা আর মাঝখানে সিরামিকের ইটের বন্ধনের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে ভবনটি। সামনের দেয়ালজুড়ে দলের সাইনবোর্ডসহ দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। সংবিধানের চার মূলনীতি খোদাই করে লেখা। বসানো হয়েছে স্টিলের নৌকা।
ভবনটির প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোর ৪ হাজার ১০০ বর্গফুট। চতুর্থ তলা থেকে ওপরের সব ৩ হাজার ১০০ বর্গফুটের। এ কার্যালয়ে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জন্য রাখা হয়েছে সুপরিসর কক্ষ। নবম তলায় দলের সভাপতির কক্ষের সঙ্গে রয়েছে বিশ্রামাগার ও নামাজের জায়গা।
এ ছাড়া বিভিন্ন তলায় ডিজিটাল লাইব্রেরি, ভিআইপি লাউঞ্জ, সাংবাদিক লাউঞ্জ ও ক্যানটিন থাকছে। বিভিন্ন তলায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যালয় থাকবে।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় থাকছে দুটি বড় সুসজ্জিত সম্মেলনকক্ষ। আর দশম তলায় ক্যাফেটেরিয়া। সবক’টি তলাতেই কক্ষ, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, শৌচাগার এবং গাছ বা টব বসানোর জায়গা আছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনটি দলীয় তহবিলের অর্থে নির্মাণ করা হয়েছে। এটা নির্মাণে ১৩ থেকে ১৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
সম্পাদনায়- আবদুল গনি