আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘৩৭ বছর হয়ে গেছে এ দলের সভাপতি হিসেবে, এতগুলো বছর থাকাটা বোধ হয় সমীচীন নয়। আওয়ামী লীগকে মনে হয় ধীরে ধীরে চিন্তা করতে হবে তার নতুন নেতৃত্বের কথা।’ তিনি সততার সঙ্গে রাজনীতি করার এবং পাওয়া না পাওয়ার হিসাব না মেলাতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কতটুকু দিতে পারলাম, কতটুকু করব, সেটাই বড় কথা।’
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তাঁর ৩৮তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে নেতাকর্মীরা শুভেচ্ছা জানাতে গেলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ’৮১ সালে তাঁর দেশে ফিরে আসার স্মৃতিচারণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই দিন প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মানুষের যে ঢল দেখেছেন, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন, তা তাঁকে এখনো আপ্লুত করে। মা-বাবা, ভাই ও পরিজনদের হারিয়ে বাংলার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাই তাঁকে চলার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাঁদের আশ্রয়েই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু।’
সংগঠনকে শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, সংগঠন যদি শক্তিশালী হয়, সংগঠনে যদি ঐক্য থাকে আর এই সংগঠন যদি জনগণের পাশে থেকে জনমত সৃষ্টি করতে পারে, তখনই যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব হয়, যা আমরা বারবার প্রমাণ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে ক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টে চলে গিয়েছিল তা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং দেশের গণতন্ত্রায়ণ ও নিরন্ন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য। ছাত্র রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়াটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক কঠিন সময়ে দেশে ফিরি। জাতির পিতার খুনিরা তখন পুরস্কৃত হয়ে বহাল তবিয়তে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স থাকায় জাতির পিতার হত্যার বিচার চাইতে পারছেন না, জিয়া তখন নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে দেশ চালাচ্ছে। আর ভাঙার চেষ্টা চলছে আওয়ামী লীগকে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যারা দেশের গণতন্ত্র দেখতে পান না; এরা সামরিক সরকারগুলোর পদলেহনকারী ও সুবিধাভোগী। অবৈধভাবে দল গঠনের মধ্যে তারা গণতন্ত্র পায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেকোনো মূল্যে চলবে। এই বিচার করতে গিয়ে যারা সাক্ষী দিয়েছে, তাদের ওপরও অনেক সময় অত্যাচার হয়েছে। যদি কেউ সাক্ষীদের নির্যাতন বা অত্যাচার করে তাহলে তারাও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের সম্মুখীন হবে এবং তাদেরও ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হবে। এ পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা বরদাশত করা হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। আমরা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ নিই। হত্যার বিচার করেছি, কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিচার তো আর হয়নি, তদন্ত হয়নি। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করছি এবং একটু নজরে রাখতে হবে যারা সাক্ষী দিয়েছে তাদের ওপর কেউ যেন অত্যাচার করতে না পারে।’
এ সময় দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও মোজাফফর হোসেন পল্টু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও কাজী জাফর উল্যাহ, দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমানসহ দলের কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথমে আওয়ামী লীগ, এরপর একে একে প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, তাঁতি লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং মহিলা শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানায়।
শেখ হাসিনা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা সম্ভব নয় : এদিকে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গতকাল এক আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হতো না। বর্তমানে বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তা শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের বলেই সম্ভব হয়েছে।
আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
আমির হোসেন আমু বলেন, ‘শেখ হাসিনার ওপরে আল্লাহর রহমত ছিল, আছে এবং থাকবে। এতে এ জাতির উত্থান ঘটেছে। আল্লাহর রহমত আছে বলেই শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টা করেও পারেনি। শেখ হাসিনা ছিলেন বলেই দেশের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশকে আকাশচুম্বী উন্নয়নের পথে নিয়ে গেছেন। যারা দেশের অর্জনকে খাটো করে, তারা দেশপ্রেমিক নয়, দেশদ্রোহী।’
আমু আরো বলেন, ‘১৯৮১ সালে এক চরম মুহূর্তে শেখ হাসিনা দেশে এসেছিলেন। আসার পর বিপদসঙ্কুল পথ। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ধরা, প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই তাঁর মৃত্যু ঘটছে। আর দলের ভেতরে ষড়যন্ত্র। এ সময়ে তিনি ভারসাম্য রক্ষা করে প্রমাণ করেছেন, তিনি অকুতোভয়ী সৈনিক হিসেবে তাঁর বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন।’
বিএনপির সমালোচনা করে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘তাদের সময় পোলিং বুথে কোনো ভোটার থাকত না। ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করে নির্বাচন করত। তারাই আজ নির্বাচন নিয়ে সততার কথা বলে। দেশের মানুষের স্মৃতি কম হলেও এত কম নয় যে তাদের দুষ্কর্মগুলো ভুলে যেতে সক্ষম হয়েছে?’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্যাটেলাইট থাকা বিশ্বের ৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। নিউক্লিয়ার অ্যাগ্রিমেন্টেও আমরা রয়েছি। বিশ্বের অন্যতম হাইয়েস্ট গ্রোয়িং ইকোনমির দেশ এখন বাংলাদেশ। এটা বৈশ্বিকভাবে প্রমাণিত। সেদিন আর দূরে নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ।’
সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘বর্তমান সরকারের উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তর হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে। আগামী দিনে ২১ আগস্ট হামলারও বিচার করা হবে। বাংলাদেশের আশীর্বাদ শেখ হাসিনা, তাঁকে ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।’
বিএনপির সমালোচনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপির কাজই হচ্ছে মিথ্যাচার করা। তারা জনগণের কাছে নালিশ করে না। কারণ জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণে তারা বিদেশিদের কাছে নালিশ করে। মিথ্যাচার ও ভাঙা রেকর্ড বাজাতে বাজাতে তারা গভীর খাদে পড়বে, যা থেকে আর উঠতে পারবে না।’